সে ভারী অস্থির সময়। ব্রিটিশ শাসনে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে ভারত ভূমি। ক্ষোভে বিক্ষোভে কাঁপছে পূর্ব ভারত। পূর্ব ভারতের এই আন্দোলন স্তব্ধ করতে চাইল ইংরেজ শক্তি। তারা আন্দোলনের তেজ কমাবার জন্য বিভেদের নীতি প্রয়োগ করলে।
১৯০৫-এর ২০ জুলাই। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করলেন।তীব্র উত্তেজনা জন মানসে। অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু তার মধ্যেও পাশ হয়ে গেল বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব। এদিকে ঝড় উঠল উত্তরের ঠাকুর বাড়িতে। এভাবে বঙ্গের অঙ্গ হানি করার চক্রান্ত কিছুতেই মানতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। ঠিক করলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির প্রতিবাদ করবেন অন্যভাবে। আগুন নয়, উত্তেজনা নয়, কোলাহল নয়। এই প্রতিবাদ একেবারে অন্য রকম।
২০ জুলাই ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করে। সরকারী তরফে জানানো হয় ওই আইন কার্যকর করা হবে ১৬ অক্টোবর। রবীন্দ্রনাথ বললেন ওইদিন রাখি উৎসব পালন করবেন তাঁরা। তারিখটা বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ আশ্বিন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন সেই ঐতিহাসিক দিনের কথা। ‘রবিকাকা বললেন রাখি বন্ধন উৎসব করতে হবে আমাদের। সবার হাতে রাখি পরাতে হবে। উৎসবের মন্ত্র অনুষ্ঠান জোগাড় করতে হবে।‘
ঠাকুর বাড়ীরতে কথা পাঠ করতে আসতেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর, তিনি মন্ত্র অনুষ্ঠান তৈরি করে দিলেন। কথা দিলেন এই উৎসবকে পাঁজিতে তুলে দেওয়ার।
অবন ঠাকুরের কথায়, ‘ ঠিক হল সকালবেলা গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখি পরানো হবে। সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানেই যাব।
রবিকাকা বললেন সবাই হেঁটেই যাবো, গাড়িঘোড়া নয়। এদিকে সকালে রাস্তার দু ধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে, মেয়েরা ফুল ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে মহা ধুমধাম। দিনু গান গাইছে –
বাংলার মাটি, বাংলার জল... পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান।
স্নান সারা হল। সাথে ছিল একগাদা রাখি । হাতের কাছে ছেলে মেয়ে যারা ছিল কেউ বাদ পরল না, সবাইকে পরানো হল। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতোগুলো সহিস ঘোড়া মলছে। হঠাৎ রবিকাকা ধা করে বেকে গিয়ে ওদের হাতে রাখি পরিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ওরা সকলেই মুসলমান। ওরা তো হতবাক’।
এই কাণ্ডের ঘোর কাটতে না কাটতেই সঙ্গের সবাইকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, চিৎপুরের বড় মসজিদ যাবেন। সেখানে সবাইকে রাখি পরাবেন।
অবন ঠাকুর লিখেছেন, ‘ আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতর একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায়’।
অনেকেই সেই ভয়ে পিছিয়ে পড়ল। কেউ কেউ সরে গেল শোভাযাত্রা থেকে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোনও দিকে খেয়াল নেই। তিনি এগিয়ে চলেছেন মসজিদের দিকে। সঙ্গে দিনু ঠাকুর, সুরেন ঠাকুর আরও অনেক।
খবর পৌঁছল জোড়াসাঁকো বাড়িতেও।সকলেই শঙ্কায় ঝামেলার ভয়ে। দারোয়ানদের তৈরি থাকতে বলা হল। শেষ পর্যন্ত ঘন্টা কয়েক পর ফিরে এলেন তাঁরা। কোথাও কোনও অশান্তির মেঘ নেই। জানা গেল বৃথা ভয় পেয়েছিলেন পিছিয়ে পড়া সঙ্গীরা।
মসজিদের ভিতরে মৌলবী থেকে শুরু করে সকলকেই শুভেচ্ছার রাখি পরিয়ে এসেছেন তাঁরা।