সাতাত্তরের বুড়ো? আরে না না বুড়ো হবে কেন, ভদ্রলোক তো চিরনবীন। কতো কতো মানুষ, গাড়ি, ঘোড়া প্রতিদিন তার বুকের উপর দিয়ে চলে যায়, কতো পাখি এসে বসে ভদ্রলোকের গায়ে। মানুষ পা দিয়ে দলে যায়, দু এক মুহুর্ত দাঁড়ায় ও কখনো কখনো। তবুও বৃদ্ধ ভদ্রলোক মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে গত সাতাত্তর বছর ধরে। আমরা সবাই চিনি এই বৃদ্ধকে। বোঝা যাচ্ছে কার কথা বলছি? যাচ্ছে না? আচ্ছা, আরেকটা ক্লু দিই। এই ভদ্রলোকের নামে একটা হিন্দি মুভি ও তৈরি হয়েছে। আর এই ভদ্রলোকের নাম যার নাম নিয়ে রাখা হয়েছে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এমন কি তার কবিতাতেও এসেছে এই শুয়ে থাকা লোকটির নাম। এবার একটু একটু বোঝা যাচ্ছে তো? তা ও বুঝলেন না? আরে সাতাত্তর বছর ধরে যে এই বুড়োটা পশ্চিমবঙ্গের দুটো ব্যস্ততম শহরকে জুড়ে রেখেছে। হ্যাঁ মশাই এবার ঠিক ধরেছেন, আমি প্রথম হুগলি সেতু বা হাওড়া ব্রিজ অথবা রবীন্দ্র সেতুর কথাই বলছি যেটা ভারতবর্ষের প্রথম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ এবং এই মুহূর্তে বিশ্বের ষষ্ঠতম দীর্ঘ ক্যান্টিলিভার ব্রিজ।
সাধারণত যে কোনো ব্রিজের নিচে পিলার দেওয়া থাকে যাতে ব্রিজটি সেই পিলারের উপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্রসেতু এমন একটি ব্রিজ যার উপর দিয়ে দিনে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ ও দেড় লক্ষ গাড়ি চলাচল করলেও এর নিচে কোনো পিলার নেই। কারণ কলকাতা বন্দর থেকে যতো জাহাজ হুগলি নদী দিয়ে যাতায়াত করে সেগুলোর পথে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয় তাই এই সেতুর নির্মাণে কোনো পিলার রাখা হয় নি।
এবার একটু এর ইতিহাস নিয়ে কথা বলি? উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মানে ১৮৫০-১৮৫১ সাল নাগাদ হুগলি নদীর দুই পাড়ে দুই যমজ শহর হাওড়া এবং কলকাতা ব্যবসা বাণিজ্যের দিক দিয়ে খুবই উন্নতি করতে শুরু করে। দুই শহরেই তখন নতুন নতুন কলকারখানা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু হাওড়ার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ পথ বলতে শুধু জলপথ। শুধু স্টিমার আর নৌকা। সেই সময়ে ইংরেজ সরকার একটা ব্রিজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। এরপর ১৮৫৫তে রেল যোগাযোগ চালু হলো, ১৮৬০ সালে প্রান্তিক স্টেশন হিসেবে হাওড়া স্টেশন তৈরি হলো এবং হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে করে কলকাতায় আসতে শুরু করলো জীবন জীবিকার তাগিদে। নানান জিনিসপত্র ও আনা শুরু হলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কিন্তু হাওড়া থেকে কলকাতায় ঢুকতে হলে সেই জলপথেই। তখন ইস্টার্ন রেলকোম্পানির তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলির সঙ্গে সরকার বাহাদুরের একটা চুক্তি হলো এবং সেই মতো লেসলি সাহেব এমন একটা সেতুর পরিকল্পনা করলেন যেটা হুগলি নদীতে কোনো পিলার না বসিয়েই তৈরি হবে। পরিকল্পনা মতোই তৈরি করা হলো একটা ভাসমান সেতু এবং ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে জনসাধারণের চলাচলের জন্য সেই ব্রিজ খুলে দেওয়া হলো।
বড় বড় জাহাজ চলাচলের জন্য এই ভাসমান সেতুর মধ্যবর্তী অংশ নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে খুলে দেওয়া হত এবং এজন্যে আগেই সংবাদপত্রে এর দরুন যানচলাচল বন্ধ থাকবে একথা বিজ্ঞপ্তি মারফত জানান দেওয়া হতো।
কিন্তু এই খোলা আর বন্ধের কারণে ব্রিজে ব্যাপক যানজট তৈরি হতে লাগলো। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো যানবাহনের চাপ এবং মাল পরিবহন। বোঝা যাচ্ছিল এই ভাসমান সেতু বা পন্টুন ব্রিজ এই বিপুল পরিমাণ যানবাহনের চাপ আর নিতে পারছে না। প্রয়োজন নতুন একটা সেতুর। ১৯৩৬ সালে শুরু হলো নতুন ব্রিজ বানানোর কাজ। এই ব্রিজেও একটিও পিলার নেই। নেই কোনো নাটবল্টু। লোহাকে বেঁকিয়ে নাটবল্টুর মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্রিজ তৈরির অধিকাংশ স্টীল সরবরাহ করেছিল জামশেদপুরের টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। প্রায় ২৬৫০০ টন স্টীল লেগেছিল ব্রিজ বানাতে এবং খরচ হয়েছিল আড়াই লক্ষ টাকা। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় হাওড়া ব্রিজ, কারণ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে এবং ভয় ছিল যে জাপান এই ব্রিজের উপর বোমা ফেলতে পারে। কেবল এক একলা ট্রাম ধীর গতিতে ব্রিজ পেরিয়ে এর শুভ সূচনা করে। কিন্তু আজ, সেই ট্রাম চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এই ব্রিজের উপর দিয়ে।
ব্রিজ চালু হওয়ার পর থেকেই এর দেখাশোনা করে আসছে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। ১৯৬৫তে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় "রবীন্দ্র সেতু" আর এই রবীন্দ্র সেতুই হয়ে উঠেছে কলকাতার আইকন। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এই ব্রিজকে এখন অপূর্ব আলোর মালায় সাজিয়ে দিয়েছে। দিনের বেলায় যানজট আকীর্ণ ব্যস্ততম রবীন্দ্র সেতুকে রাত্রিবেলা দেখলে মনে হয় স্বর্গপুরীর প্রবেশ দ্বার।
তাহলে শুনলেন তো আমাদের কলকাতা শহরের অভিজ্ঞান চিরনবীন রবীন্দ্র সেতুর কথা যে সেতু নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন "হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে, হ্যারিসন রোড চলে তার পিছে পিছে"..