সে এক দিন ছিল, যখন লাল-সাদা রঙ আর জুঁই ফুলই ছিল দিনটার বিশেষত্ব। তবে সে বিকেলে। সকাল থেকেই পুজো পুজো ভাব। উৎসবের মত করেই সুর ভেসে আসত। ‘এসো হে বৈশাখ’। উদাত্ত কন্ঠ। দেবব্রত। কণিকা। সুমিত্রা সেন। পুরোনো গন্ধ। গ্রীষ্মের স্মৃতিময়তা। রবীন্দ্র জয়ন্তী। এই শব্দবন্ধটাই আলাদা ঘোর তৈরী করত। তবে প্রস্তুতি শুরু হত অনেক আগে থেকেই। বাড়ির উঠোন জুড়ে কাপড় মেলা হয়েছে। সরু লিকলিকে বাঁশগুলোর দেখা মিলত এ সময়ই। রবীন্দ্রজয়ন্তীর নির্দিষ্ট দিনের আগেই বৈঠক শুরু হত। আবেগের স্রোতে ভাসা। নির্দিষ্ট দিনে কার জন্যে কি বরাদ্দ থাকবে তাই নিয়ে চলত আলোচনা। কবিতা পাঠ, গান, নাচ মিলিয়ে রামধনু সাজানোর পরিকল্পনা। আকাশে তখন ঝলমলে রোদ্দুর। উঠোনের মাঝেই শুরু হয়েছে বৈঠক। খুদে চোখগুলোর দৃষ্টি মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে। ঝড় উঠবে না তো..! আশায় বুক বাঁধা তবুও। সেদিন সব ঠিক থাকবে তো! ফুলের ব্যবস্থা না হয় সেদিন হবে, তার আগে অনুশীলনের সময় নকল ফুল জোগাড় হত। বাড়ির উঠোন জুড়ে হই-হই। কেউ গান গাইছে, তালে তালে চলছে নাচ। আবার অন্যদিকে হাতে লিখে চলছে কবিতা-পাঠ। ঘেমে-নেয়ে চলছে অনুশীলন। কিন্তু কোথাও ক্লান্তি নেই। সন্ধ্যে হলে ঘুম নেমে আসত। কিন্তু মনের ভেতর তখনো সুর বাজছে।
শুরু রিহের্সালের পালা। প্রস্ততি চলত সকাল- বিকেল। গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর পরই। তাই হুড়মুড়িয়ে ফিরতে হবে স্কুল থেকে। বিকেলেই বসবে জলসার আদলে আসর। সেই জলসার মধ্যেই হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তখনই বুকের মাঝে ধুকপুক। ঠিক হবে তো সবটা। সন্ধ্যেবেলা মুড়ি মাখা দিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। তবু মন নেই তাতে। মনের মধ্যেও গুড়গুড় করছে। গান বাজছে। “তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে”। জলসার সুর বাজছে মনের ভেতরেও। এরকম ভাবেই কেটে যেত রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগের দিনগুলি। তারপর অপেক্ষার প্রহর গোনা।
এবার পোশাক নির্বাচনের পালা। রঙে রঙে অনুভূতির মেলা। তবুও সব রঙ ছেড়ে সেই ওই দুটো রঙের প্রতিই টান। লাল-সাদা। প্রাণের ঠাকুরের জন্যে ভালোবাসায় ভরা শ্বেতশুভ্র রঙের সঙ্গে মেশানো প্রেমের রঙ লাল। সঙ্গে জুঁইফুল। এই ছিল সাজ।
সাজেও চলত অনুশীলন।
তারপর সেই দিন আসত। রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব। ঘোর লাগা বিকেল ছিল সে সেব দিনে। খোলা মাঠে বাঁধা হত মঞ্চ। সাটিনের কাপড় ঝিলিক দিত সেখানে। আলোর ব্যবস্থাও থাকত তখন। গোটা মাঠ জুড়ে ম-ম করছে জুঁইফুলের গন্ধ। চারিদিকে লাল-সাদা রং-এর মেলা। মাইকের ব্যবস্থা পাকা কি না দেখা হয়ে গিয়েছে।
সাদা পর্দা ফেলা রয়েছে মঞ্চে। বুক দুরু দুরু শুরু। মঞ্চে সব ঠিক থাকবে তো! এদিকে আকাশেও কালো মেঘ। সব ভয় এসে একসঙ্গে জড়ো হচ্ছে। তবুও পাল তুলে দেওয়া হত। তরী বাওয়ার মত করে। গান, নাচ, কবিতা, নাটক সব মিলিয়ে আলো-আলো সময়। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখে নেওয়া। সব ঠিক আছে তো! পথ পেরোনোর মত করে দিন পেরোনো। ঠিক কেটে যায়। দিন শেষের ক্লান্তি মুছে সবার মুখে তখন আলো। সব ঠিক হয়েছে। লাল-সাদা রঙের শাড়ি ঘামে ভেজা। নাছোড় জুঁই ফুল তখনও সুবাস ছড়াচ্ছে। আমাদের ভেতরে সাদা রঙের আঁকি-বুকি কাটা চলছে।
এ তো গেল পাড়ার অনুষ্ঠানের কথা। স্কুলেও পালিত হত রবীন্দ্র জয়ন্তী। গ্রীষ্মের ছুটির আগে। সেদিনটাও মনের ভেতর আবেগ আর সুর উড়ে বেড়াত। ঠাকুরের পুজো। নির্দিষ্ট সাজ সেদিন। স্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক ঝেড়ে ফেলে লাল-সাদায় সেজে ওঠা। পছন্দের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে বার বার যাওয়া। শেখা। ইচ্ছে-কুঁচির উদযাপন।
সময় বদলেছে। নেটিজেন আর ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের জাঁকজমক। প্রচার আর প্রসার। সবই রয়েছে। আজও রবীন্দ্র জয়ন্তী ঠাকুরের পুজো। উৎসব। তবুও এই দিনটা এলেই অজস্র লাল-সাদা রঙের শামিয়ানা দুলতে থাকে। আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় জুঁইফুলের গন্ধ।