কমিক টাইমিং থেকে শুরু করে সিরিয়াস অভিনয়, আবার মজার ভিলেন; সবেতেই তিনি ছিলেন হিট। সহঅভিনেতারা ভয়ও পেতেন তাঁকে, সে তাঁর দৃশ্য চুরি করার ক্ষমতাকে। অরণ্যের দিনরাত্রি-র শেখর হোক, বা বিরিঞ্চি বাবার সহকারী, বাঙালি ভুলবে না কোনদিন। সিরিয়াস অভিনয়ের মধ্যেও হাসির পাঞ্চ ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর বাঁ হাত কি খেল! তিনি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। তবে ওই নামে কেউ তাঁকে ঠাওর করতে পারবে না। তিনি আমাদের রবি ঘোষ, বাংলা সাহিত্য এবং পর্দার আইকোনিক চরিত্রজুড়ে রবি ঘোষের ছোঁয়া লেগেছিল। কালোতীর্ণ হয়ে উঠেছিল চরিত্রগুলি।
২৪ নভেম্বর ১৯৩১ সালে কোচবিহারে মামার বাড়িতে জন্ম রবি ঘোষের, পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পাঁচ ভাইবোনের শিল্প তিনি দ্বিতীয় ছিলেন। ১৯৪৯ সালে সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারপাশ করে তিনি ভর্তি আশুতোষ কলেজ। তবে জীবনে অভিনেতা নয়, প্রথম জীবনে বডিবিল্ডার হতে চেয়েছিলেন। ভাল গল্ফও খেলতেন, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। কলেজে পড়াকালীন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন বন্ধুমন নামে একটি নাটকের দল। মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। বাবা এসব পছন্দ ছিল না। তবে মায়ের সমর্থন ছিল। বাবাকে লুকিয়ে মহড়া সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। মঞ্চে অভিনয়ের ঠিক পাঁচদিন আগে বাবা চলে গেলেন। মাকে বললেন‚ তাঁর দলের অনেক ঋণ বাজারে। শো বাতিল হলে মুশকিল। অশৌচের মধ্যেই মঞ্চে নামলেন। নাটকের প্রতি এই কমিটমেন্ট চিরদিন ছিল। ছোট বোন তপতী চলে গেল, তার কয়েক ঘণ্টা পরে মঞ্চে বেদম হাসির নাটক কনে বিভ্রাট দেখে কেউ আঁচও করতে পারেনি সদ্য বোনকে হারিয়েছেন রবি ঘোষ। অভিনেতা নয়, কমেডিয়ান নয় বরং জাত চরিত্রাভিনেতা ছিলেন রবি ঘোষ।
উত্তম-সৌমিত্রদের যুগেও তিনি ভেঙেছিলেন স্টিরিওটাইপ তকমা। বডিবিল্ডার' হতে চাওয়া কালো, বেঁটে খাটো ওই লোকটা সেই যুগে একটাই মিনার্ভা থিয়েটার হাউসফুল করতেন। গল্প হলেও সত্যি, গুপী গাইন বাঘা বাইন, অভিযান, অরণ্যের দিনরাত্রি, হীরক রাজার দেশে, পদ্মানদীর মাঝি, বসন্ত বিলাপ, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, এমন অজস্র ছবিতে একের পর এক চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু, ১৯৬১-তে পাট চুকিয়ে পাকাপাকিভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বাছলেন রবি ঘোষ।
উৎপল দত্তের অঙ্গার নাটকে তাঁর অনবদ্য অভিনয় দেখেছিলেন পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তারপর সুযোগ দেন রবিকে। তিনি অঙ্গার নাটকের জন্য উল্টোরথ শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৬০-এ। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে আহবান-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়‚ নায়িকা সন্ধ্যা রায়‚ নবাগত রবি ঘোষ। রবির জীবনের মোড় ঘুরে যায় তপন সিনহার গল্প হলেও সত্যিতে অভিনয়ের পর। ছোট্ট পিন্টু কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রভাতী গানে সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। গান শিখিয়েছে 'কাজের লোক' ধনঞ্জয়। ধূমকেতুর মতো তার উদয়, সে ফিল্ম আর্টিকেল লিখতে রসদের জোগান দিচ্ছে, সুর ধরিয়ে দিচ্ছে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে, আবার নারকেল মালা দিয়ে কলতলার শ্যাওলা ২মিনিটে সাফ করতে পারে, রান্না হাত মারাত্মক সাধারণ এঁচোড়-কোপ্তায় পাঁঠার মাংসের অতুলনীয় স্বাদ আনে, বাড়ির বৌ-দের চা জলখাবার করে খাওয়ায়, মা-বাপ মরা বাড়ির অপাংতেয় মেয়ের মুখে হাসি ফোটায়। ধনঞ্জয় মানে মুশকিল আসান, একান্নবর্তী পরিবারকে বেঁধে রাখা। ১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে বাঘার চরিত্রে অভিনয় তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান তিনি। পরিচালনাতেও হাত পাকিয়েছেন, ১৯৭৬ সালে 'নিধি রাম সর্দার' ও ১৯৭৪ সালে 'সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা' নামে দুটি সিনেমা পরিচালনা করেন। প্রায় দুশো কাছাকাছি ছবিতে পার্ট করেছেন তিনি।
সিরিয়াস চিত্রনাট্যে এক চিলতে খোলা হাওয়া তিনি, গল্পের আদ্যপান্তজুড়ে রাজত্ব করা, তাঁর স্বকীয় ভঙ্গি। রবি ঘোষ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন টলিউডে কখনও হাসি, কখনও হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা কঠিন বাস্তব। নিজেকে বারে বারে ভেঙে গড়েছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের স্বর্ণ যুগের এক অধ্যায় ছিলেন রবি ঘোষ। শ্রীমান পৃথ্বীরাজে তিনি হরিদাস, বুলবুল ভাজাতে কেল্লাফতে করতেন। তাঁর হাতের স্বাদে মুগ্ধ ছিলেন খোদ কুইন ভিক্টোরিয়াও। বাঙালির নস্টালজিয়া, শৈশব থেকে কৈশর, এমন কি প্রবীণদের কাছে অনন্য বাঘা। ভূতের রাজার বর পেয়ে একের পর এক অসাধ্য সাধন করে তোলা। অরন্যের দিন-রাত্রীর শেখর। চাকরি নেই, খুব সাধারণ এক মানুষ, বন্ধুদের নিয়ে দিব্যি আছেন। আবার বিরিঞ্চি বাবার অ্যাসিস্টেন্ট, ধন্যি মেয়ের তোতলা ভট্টচাজ, বাঙালি আজও তাঁকে ভুলতে পারেনি। আজ এই দিকপাল কিংবদন্তির জন্মদিন।