রস শব্দটির অর্থ ব্রহ্ম। রস থেকেই রাসের উৎপত্তি। রাস এক গভীর দর্শন। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরেই পালিত হয় রাস উত্সব।
‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ’’। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই মধুর রসের আধার। তাঁকে ঘিরেই রচিত হয় রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য।
কৃষ্ণের ডাকাতিয়া বাঁশিতে আকুল হয়েছিলেন রাধা এবং সখীরা। তাঁরা সকলেই নিজের করে পেতে চেয়েছিলেন। ভক্তের ভক্তির জোরে সম্ভব হয়েছিল সেই অলৌকিক। একই সঙ্গে কথিত আছে বৃন্দাবনের নিধু বনে নাকি এখনও রাসলীলায় মেতে ওঠেন কানাইয়ের সাথে ব্রজ গোপীরা।
রাস উৎসব উপলক্ষ্যে আশ্চর্য উৎসবে মেতে ওঠে খড়দা। হয়ে ওঠে যেন বাংলার গুপ্ত বৃন্দাবন। এই ভূমিতেই আছে ‘শ্যামের বাড়ি’ আর ‘কুঞ্জবাটি’। এখানে আছে শ্রীশ্রীরাধা-শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দির। উত্তর চব্বিশ পরগনার খড়দা অঞ্চলটি বৈষ্ণবদের অন্যতম তীর্থস্থান হিসাবে পরিগণিত হয়।
শ্রীপাট খড়দার ঐতিহাসিক রাধা-শ্যামসুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল ভক্তিবিপ্লব। শ্রীরাধা-শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দির স্থানীয় নামে ‘শ্যামের বাড়ি’। শ্রীশ্যামসুন্দরের মন্দিরের কাছেই কুঞ্জবাটী।
‘চৈতন্যভাগবত্’ গ্রন্থ অনুসারে, শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণের পর শচীমায়ের সঙ্গে দেখা করবার পর সমগ্র গৌড়বঙ্গ পরিভ্রমণ করেন। তাঁর যাত্রা ছিল বৃন্দাবনভূমির দিকে। সেই সময়ে একবার খড়দহে পদধূলি দেন তিনি।
পরবর্তীকালে চৈতন্য-সহচর নিত্যানন্দ খড়দায় এসে বসুধা ও জাহ্নবাদেবীকে বিবাহ করে সেখানেই বসবাস আরম্ভ করেন। নিত্যানন্দ যে বাড়িটিতে থাকতেন, বর্তমানে সেটি ‘কুঞ্জবাটী’ নামে খ্যাত।
প্রভু নিত্যানন্দ সময় থেকেই খড়দা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে শ্যামসুন্দর-রাধারানি-র বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাসযাত্রা স্থানীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়। আগে এই রাস উৎসব প্রধানত শ্যামসুন্দরের পুরনো মন্দির ‘কুঞ্জবাটী’ ঘিরেই অনুষ্ঠিত হত। পরে, নাথুপাল ঘাটের কাছে রাসমঞ্চ স্থাপিত হবার পর, রাসের তিন দিন এই রাসমঞ্চ ও মন্দির ঘিরে চলে উৎসব।
খড়দার রাস উৎসব কয়েকটি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। রাসোৎসবের প্রথম পর্ব আরম্ভ হয় ‘গোপাষ্টমী’র দিন থেকে।
রাসের এক সপ্তাহ আগে অষ্টমীর দিন মধ্যাহ্নের পর শ্যামসুন্দর চতুর্দোলায় চড়ে খড়দার পুরনো বাজার অঞ্চলের গোষ্ঠমন্দিরে আসেন গোপিনীদের সঙ্গে লীলা করবার জন্য। কিন্তু সেই লীলায় রাধারানী থাকেন অন্য ভূমিকায়।
শ্যামসুন্দর চতুর্দোলায় রওনা হলে তাঁর পিছনে পিছনে আরেকটি চতুর্দোলায় চড়ে রাধারানিও বের হন। তিনি নজর রাখেন শ্যামের ওপর। এই বাজার অঞ্চলেরই অন্য একটি মন্দিরে অপেক্ষা করেন শ্রীরাধা। তাঁর হাতে থাকে সোনার ঝাঁটা। শ্যামের জন্য।এদিকে শ্যামের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। গোপিনীবিহার শেষ হলে শ্যামসুন্দর গোষ্ঠমন্দির থেকে বেরিয়ে ভক্তদের পুজো গ্রহণ করে রাত দশ ঘটিকায় ফিরে আসেন নিজের মন্দিরে।
এবার শুরু হয় মানভঞ্জন পর্ব। শ্যামের অদর্শনে দীর্ঘ অপেক্ষায় মান করে বসে আছেন যে মানিনী রাধা। তারওপর তাঁর জানতে বাকি নেই যে শ্যাম অন্য গোপিনীদের কাছে গিয়েছিলেন। রাধাকে ননী-মিছিরি খাইয়ে তাঁর রাগ ভাঙান শ্যামকিশোর। তাঁদের মিলন ঘটে শেষে।
রাসযাত্রার তিনদিন সন্ধ্যায় নিত্য পুজো সমাপ্ত হবার পর শ্যামসুন্দর-রাধারানিকে চতুর্দোলায় বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গা তীরবর্তী রাসমঞ্চে। প্রথম দু-দিন তাঁরা সেখানে সারা রাত কাটিয়ে ভোরে ফিরে আসেন মন্দিরে। তৃতীয় দিনে আর ভোরে মন্দিরে ফেরেন না শ্যাম-রাধা। দিনটিকে বলা হয় ‘গোষ্ঠ’।
গোষ্ঠের দিন দুপুর পর্যন্ত রাসমঞ্চে থেকে তাঁরা পুজো গ্রহণ করেন। বিকেলের দিকে শ্যাম-রাধাকে সংকীর্তন সহকারে রাসমঞ্চ থেকে শ্যামের মন্দির অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হয়। একে বলে ‘গোষ্ঠবিহার’। এই সময়ে শ্যাম-রাধা পুরবাসীদের দ্বারে দ্বারে যান পুজো গ্রহণ করতে। গোষ্ঠবিহার শেষে তাঁরা ফিরে আসেন মূল মন্দিরে।
তারপর শুরু হয় ‘বিরাট ভোগ’। এই ‘বিরাট ভোগ’র আকর্ষণ ‘ভোগ লুঠ’ পর্ব। একটি বিরাট চৌবাচ্চার মধ্যে রাখা হয় খিচুড়ি ভোগ। বিরাট ভোগের আয়োজনে যে দৃষ্টি দেন কৃষ্ণ, তাঁকে ‘দৃষ্টি ভোগ’ বলা হয়৷ শ্যামের এই দৃষ্টিভোগের প্রসাদ খড়দহের রাসের অন্যতম জরুরি অঙ্গ৷’ শ্যাম-রাধা নাটমন্দিরে এলে তাঁদের সামনে ভক্তরা ওই চৌবাচ্চা থেকে খিচুড়ি লুঠ করে নিয়ে যান। ‘বিরাট ভোগ’-এর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় রাস উৎসব। রাসের মেলা চলে পুরো মাস ধরে।
৯৭৭ বঙ্গাব্দের মাঘী পূর্ণিমায় অদ্বৈত আচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র অচ্যুতানন্দ গোস্বামী শ্যামসুন্দরকে কুঞ্জবাটীতে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নিত্যানন্দের সহধর্মিণী জাহ্নবী দেবীর ইচ্ছেয় শ্রীশ্যামসুন্দরের বামে অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরে কুঞ্জবাটীতে বিগ্রহসেবার যথেষ্ট জায়গার অভাব দেখা দিলে চারশো বছরেরও বেশি আগে নির্মিত হয় বর্তমান শ্যামসুন্দর মন্দির। বর্তমানে কুঞ্জবাটীতে নিতাই-গৌর এবং বীরভদ্র গোস্বামীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত।
কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ খড়দহে এসে শ্যামসুন্দর দর্শন করেছেন। এসেছেন শ্রীমা সারদামণিও। শ্রীশ্রীমা পরবর্তী কালে ভক্তদেরও বলেছেন, ‘‘ঠাকুর বলতেন, ‘দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী, কালীঘাটের কালী আর খড়দার শ্যামসুন্দর— এঁরা জীবন্ত, হেঁটে চলে বেড়ান, কথা কন, ভক্তের কাছে
খেতে চান।’...