প্রায় শেষ কাউন্ট ডাউন। আগামী রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে সবথেকে বড় 'ইভেন্ট' বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রথম দিন নামছে আয়োজক দেশ কাতার। ম্যাচ ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ৯টা থেকে। বিশ্বকাপের ফাইনাল ১৮ ডিসেম্বর।
আয়োজক দেশ কাতার এবং ইকুয়েডরের মধ্যে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে প্রতিযোগিতা। তার আগে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্যাতনামীরা আসবেন সেই অনুষ্ঠান করতে।
তবে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনায়ও। এত ছোট দেশে এত বড় মাপের প্রতিযোগিতা কেন আয়োজন করতে দেওয়া হল, তা নিয়েই প্রশ্ন। প্রাক্তন ফিফা সভাপতি শেপ ব্লাটারও মেনে নিয়েছেন, কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তবে বিশ্বকাপ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা কমে যাবে বলে মনে করছেন আয়োজকরা।
বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ এবং অনুষ্ঠান হবে আল বায়েত স্টেডিয়ামে। দোহার কেন্দ্র থেকে ৪০ কিমি দূরে আল খোরে সেই স্টেডিয়াম। ৬০ হাজার দর্শক খেলা দেখতে পারবেন। ভারতীয় সময় সন্ধে ৭.৩০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। কারা অনুষ্ঠান করবেন তার তালিকা এখনও প্রকাশ করা হয়নি ফিফার তরফে। তবে একটা ইঙ্গিত মিলেছে বিভিন্ন তরফে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বিখ্যাত ব্যান্ড বিটিএস-এর জানকুক পারফর্ম করবেন। এ ছাড়া কলম্বিয়ার গায়িকা শাকিরা, ব্ল্যাক আয়েড পিস, রবি উইলিয়ামস এবং ভারতের নোরা ফতেহির পারফর্ম করার কথা হয়েছে। শোনা গিয়েছিল ব্রিটিশ গায়িকা ডুয়া লিপাও থাকবেন। তবে সেই দাবি অস্বীকার করেছেন তিনি। কাতারের তরফে বিরাট অর্থে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল গায়ক রড স্টুয়ার্টকে। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশটি কাতার বলেই।
এ ছাড়াও ফিফার ফ্যান ফেস্টিভ্যাল হবে দোহার আলবিদ্দা পার্কে। সেখানে এক মাস ধরে পারফর্ম করবেন বিভিন্ন খ্যাতনামীরা। বিনামূল্যে দর্শকদের কাছে এই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া মোট ৩২টি দলকে আটটি গ্রুপে রাখা হয়েছে। গ্রুপ এ-তে রয়েছে কাতার, ইকুয়েডর, সেনেগাল, নেদারল্যান্ডস। গ্রুপ বি-তে ইংল্যান্ড, ইরান, আমেরিকা, ওয়েলস। গ্রুপ সি-তে আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, মেক্সিকো, পোল্যান্ড। গ্রুপ ডি-তে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, টিউনিসিয়া। গ্রুপ ই-তে স্পেন, কোস্টারিকা, জার্মানি, জাপান। গ্রুপ এফ-এ বেলজিয়াম, কানাডা, মরক্কো, ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ জি-তে ব্রাজিল, সার্বিয়া, সুইৎজারল্যান্ড, ক্যামেরুন। গ্রুপ এইচ-এ পর্তুগাল, ঘানা, উরুগুয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া।
গ্রুপ পর্বে প্রতিটি দল তিনটি করে ম্যাচ খেলবে। সেই ম্যাচগুলি শেষে দু'টি করে দল যাবে নক আউট পর্বে। যদি গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কোনও দলের পয়েন্ট সমান হয়, তা হলে গোল পার্থক্যে এগিয়ে থাকা দল যাবে পরের পর্বে। সেটাও যদি সমান হয় তা হলে যে দল বেশি গোল করেছে সেই দল যাবে পরের পর্বে। যদি তা-ও সমান হয় তা হলে যে দুই দলের মধ্যে সমান পয়েন্ট, গোল পার্থক্য এবং গোল সংখ্যা রয়েছে তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের ম্যাচের পরিসংখ্যান দেখা হবে। তাতে যদি পয়েন্ট এবং গোল সমান হয় তা হলে যে দল কম কার্ড দেখেছে, সেই দল যাবে পরের রাউন্ডে। সেটাও যদি সমান হয় তা হলে ফিফার ক্রমতালিকায় যে দল এগিয়ে রয়েছে, সেই দল যাবে নক আউট পর্বে।
গ্রুপ পর্বের ম্যাচ চলবে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল ৩ ডিসেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর। কোয়ার্টার ফাইনাল ৯ ও ১০ ডিসেম্বর। দু'টি সেমিফাইনাল ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর। ফাইনাল ১৮ ডিসেম্বর। ১৭ ডিসেম্বর তৃতীয় স্থান নির্ণায়ক ম্যাচ।
মোট আটটি স্টেডিয়ামে হবে খেলা। যে দেশে ফুটবলের সে রকম কোনও পরিকাঠামোই ছিল না, তারাই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে একের পর এক চোখধাঁধানো স্টেডিয়াম বানিয়ে দিয়েছে। এক মাস ধরে চলা বিশ্ব ফুটবলের লড়াইয়ে নজর থাকবে লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেমারদের মতো তারকাদের দিকে। উঠে আসতে পারে অন্য কোনও নতুন নামও। সারা বিশ্বের নজর থাকবে কাতারের ফুটবল যুদ্ধের দিকে।
অন্যদিকে ফুটবল বিশ্বকাপের আগে একের পর এক বিতর্কে জড়াচ্ছে কাতার। এ বার বিতর্ক কাতারের আরও একটি আইন নিয়ে। সে দেশে মহিলারা খোলামেলা পোশাক পরতে পারেন না। তাঁদের সব সময় শরীর ঢেকে রাখতে হয়। বিশ্বকাপ দেখতে আসা সমর্থকদেরও সেটা মেনে চলতে হবে। কোনও মহিলা দর্শক খোলামেলা পোশাক পরলে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। জেলের সাজা পর্যন্ত হতে পারে।
জানা গিয়েছে, কাতারে পা রাখা বিদেশি সমর্থকদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা যাতে খোলামেলা পোশাক না পরেন। মূলত কাঁধ ও হাঁটু ঢেকে রাখতে হবে তাঁদের। এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দর্শকদের কোনও বিশেষ পোশাক পরতে বলা হচ্ছে না। তাঁরা নিজেদের পছন্দের পোশাকই পরতে পারেন। তবে খোলামেলা পোশাক পরা যাবে না। শুধু স্টেডিয়াম নয়, মিউজ়িয়াম ও অন্যান্য সরকারি দফতরে গেলেও শরীর ঢাকা পোশাক পরতে হবে তাঁদের।
শুধু স্টেডিয়ামের বাইরে নয়, স্টেডিয়ামের ভিতরেও দর্শকদের পোশাকের দিকে নজর রাখা হবে। কাতার বিশ্বকাপের চিফ টেকনোলজি অফিসার নিয়াস আব্দুলরহিমান বলেছেন, ''স্টেডিয়ামে আমরা অত্যাধুনিক ক্যামেরা বসিয়েছি। সেই ক্যামেরার সাহায্যে বিশেষ একটি আসনের দিকেও ভাল করে লক্ষ্য রাখা যাবে। পুরো বিষয়টা রেকর্ড করা হবে। তা হলে পরবর্তীতে প্রয়োজন পড়লে আমরা রেকর্ডিং দেখতে পারব। দর্শকদের পোশাকের দিকে নজর রাখব আমরা।''
ফিফা অবশ্য জানিয়েছে, দর্শকরা চাইলে যে কোনও পোশাক পরতে পারেন। সেটা তাঁদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু দর্শকদের কাছে অনুরোধ করা হচ্ছে, আয়োজক দেশের আইনের কথা মাথায় রেখে যাতে তাঁরা পোশাক পরেন।
রক্ষণশীল দেশ কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন স্টেডিয়ামে বসে দর্শকরা বিয়ার খেতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। বিশ্বকাপের আগে অবশ্য আয়োজকরা জানিয়েছেন, দর্শকদের জন্য বিয়ারের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু তার দাম অনেক বেশি। খাওয়া যাবে না যত ইচ্ছা। মানতে হবে বেশ কিছু নিয়ম।
কাতারে মদ নিষিদ্ধ। তাই কয়েকটি মাত্র হোটেলে বিয়ার বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মূলত যে হোটেলগুলিতে বিদেশি সমর্থকরা থাকবেন সেখানেই এই সুবিধা থাকবে। তবে প্রতিটি স্টেডিয়ামে বিয়ার পাওয়া যাবে। কাতার বিশ্বকাপের দায়িত্বে থাকা কমিটির সিইও নাসের আল খাতার জানিয়েছেন, ৫০০ মিলিলিটার বিয়ারের বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৯৭৫ টাকা। এ ছাড়া জল কিনতে গেলেও ভাল টাকা দিতে হবে দর্শকদের। ৫০০ মিলিলিটারের এক বোতল জলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০০ টাকা।
চাইলেই যে কেউ বিয়ার কিনতে পারবেন না। কেনার আগে তাঁকে প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁর বয়স ২১ বছরের বেশি। তার কম বয়সি কাউকে বিয়ার বিক্রি করা হবে না। ২১ বছরের কম বয়সি কেউ বিয়ার খেতে গিয়ে ধরা পড়লে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তা ছাড়া এক জনকে একসঙ্গে চার বোতলের বেশি বিয়ার বিক্রি করা হবে না বলেও জানিয়েছেন আয়োজকরা। বিশ্বকাপ চলাকালীন কাতারে একটি নির্দিষ্ট সংস্থার বিয়ার বিক্রি হবে। সেই সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্টেডিয়ামের বাইরে নিজেদের স্টল তৈরি করতে। এবং সেটা যেন স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশপথ থেকে দূরে হয়। আয়োজকরা যা নির্দেশ দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিয়ার সংস্থাকে।
কাতারে আরও অনেক কড়া নিয়ম রয়েছে। যেমন, প্রকাশ্যে থুতু ফেলা যাবে না। ৬০০০ পাউন্ড (৫ লক্ষ ৭৯ হাজার টাকা) জরিমানা হতে পারে। সরকারি বাড়ির আশেপাশে নিজস্বী তোলা যাবে না। প্রায় ১২ লক্ষ ফুটবলপ্রেমী কাতারে বিশ্বকাপের খেলা দেখতে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কাতারের কঠোর আইন-কানুন মেনে চলতে হবে তাঁদের। মধ্য প্রাচ্যের দেশটির কিছু আদবকায়দাও জেনে রাখা জরুরি।