পরম্পরা মেনে ভাদ্রের শেষদিন ধুমধাম করে পালিত হল ‘ছাতা পরব’

বাংলার প্রতিটি কোণায় রয়েছে অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্য। সেই কারণেই এই বাংলার টানেই দূরদূরান্ত থেকে আসেন পর্যটকরা। বাংলার মানুষ ও সংস্কৃতি উৎসবমুখর, আর সেই উৎসবের মধ্যেই অন্যতম পুরুলিয়ার ছাতা পরব বা ছাতা উৎসব

এবছরেও ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন ধুমধাম করে পুরুলিয়াবাসী পালন করেন তাঁদের এই মিলন উৎসব। পুরুলিয়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে চাকলতোড় গ্রামে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। সন্ধ্যে থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেন আদিবাসী তরুণ তরুণীরা। আদিবাসীদের ভিড়ে গমগম করে উৎসবপ্রাঙ্গন। সারা রাত ধরে চলে মেলা। এই মেলাকে তাঁরা মিলন মেলা হিসেবেই দেখেন।

পূর্বাঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে পুরুলিয়ার ছাতামেলা আজও সবথেকে বড় মিলনমেলা গুলির অন্যতম। আর এই উৎসবের বিশেষ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগে রাজতন্ত্রের জয়জয়কার-চিত্র দেখতে পাওয়া যায় এখানে। যদিও তা সাময়িক সময়ের জন্য, কারণ এখানে একদিনের জন্য রাজবেশধারী হয়ে ১০০ ফুট লম্বা একটি দণ্ডে সাদা রঙের অতিকায় ছাতা তুলে ধরেন ক্ষত্রিয়বংশী রাজা। পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তর পুরুষদের একাংশ রয়েছেন এই গ্রামে। অতীতে তাঁরাই ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক।

প্রায় ৫০০ বছরের সেই পরম্পরাকে এখনও ধরে রাখা ও সম্মানজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে তাঁরা আয়োজন করেন এই উৎসবের। গল্পে, কবিতায়, সিনেমায় যে ‘রাজা’ মানুষ দেখেছে ও জেনেছে তারই এক বাস্তবিক রূপ এখানে গেলেই প্রতক্ষ্য করা সম্ভব।  

এই উৎসবের একটি ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতাও রয়েছে। বলা হয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় আদিবাসীদের নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই এলাকায় জয়ী হন কাশীপুরের রাজা। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রথম ছাতা তোলেন তিনি। প্রতি বছরের মতো এবারেও রাজবংশের সন্তান অমিত সিংদে এই রীতি পালন করেন। তারপর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে এই মেলায়।

এই মেলার রয়েছে আরো একটি তাৎপর্য, বলা হয় চাকলতোড়ের ছাতা মেলা’য় না গেলে সাঁওতাল কন্যারা ‘পরিণত নারী’ হতে পারে না। তাই এই মেলায় কিশোরী তরুণীদের ভিড় হয় সবথেকে বেশি।

এই একদিনের মেলায় অনেকসময় পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনও হয়ে থাকে। ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার এমনকি ছত্তিসগড় থেকে আসেন নারী-পুরুষ, চলে একে অপরের সাথে আলাপচারিতা। নাচ-গান-মাদল-মহুয়া-আচার-অনুষ্ঠান-আনন্দের মধ্যেই জীবনসঙ্গী হিসাবে কাউকে পছন্দ হলে একরাতের মধ্যেই নির্ধারিত হয় বিবাহ।

আদিবাসীদের সংস্কৃতির নির্যাস পেতে হলে এই উত্সবে সামিল হতে হবে সশরীরে, এটি যে বাংলার ঐতিহ্য বৈচিত্রকে এখনো ধরে রেখেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...