কেউ দুধে। কেউ নুনে। কেউ বা রাস্তায়, বাতিলের আস্তাকুড়ে। এভাবেই প্রতিবছর মৃত্যু হয় অজস্র প্রাণের। রোগ নয়। অসুস্থতা নয়। শুধুমাত্র ‘কন্যা’ হওয়ার কারণে। কখনও বা জন্মের পর। কখনও বা গর্ভাবস্থাতেই।
সংখ্যাটা প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজারের কাছাকাছি।
২০১৮-তে জাতিসংঘের প্রকাশিত এক রিপোর্টে সামনে আসে এই তথ্য। নড়েচড়ে বসেছিল সব মহল। কিন্তু ছবিটা খুব বদলায়নি।
গর্ভের সন্তান কন্যা-জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই বিনাশ ঘটানোর ব্যবস্থা হয়ে যায়। দেশে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ আগে থেকে জানবার চেষ্টা করা বা এতে সাহায্য করা আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।
ভারতের উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে লিঙ্গগত বৈষম্যের কারণে মৃত্যুর হার অত্যাধিক বেশি। গণসচেতনতা গড়ে তুলতে চলছে বহু সরকারী প্রকল্প। কিন্তু হতাশার মাত্রা তাতে খুব হেরফের হয় না।
১৯৬১ সালের জনগণনাতে ১০০০ জন শিশুপুত্রের নিরিখে কন্যা সন্তানের হার ছিল ৯৭৬। ২০১১-এ সেই হার হয়েছে ৯১৪।
এই পরিসংখ্যানই ভাবনার ভিত নাড়িয়ে দেয় ডাক্তার গণেশ রাখের।
ডাক্তার গণেশ রাখ এই মুহূর্তে পুণের এক সাড়া জাগানো নাম। চিকিৎসক মহলে যত না, তার চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ মানুষের মধ্যে।
২০০৭ সালে পুণে শহরে একটা ছোট্ট হাসপাতাল শুরু করেন। আজ সেই হাসপাতাল চিকিৎসা জগতের অনুপ্রেরণা।
কন্যা সন্তানদের যাতে কুঁড়ি অবস্থাতেই হারিয়ে যাতে না হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন এই ডাক্তারবাবু। প্রায় এক দশক ধরে।
ডাক্তার রাখ বলেন, সমাজকে আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু নিজের হাতে যতটুকু আছে সেটুকু দিয়ে বদল আনার চেষ্টার শুরু তো করতেই পারি।
সেই ভাবনা থেকেই তাঁর হাতে প্রতিটি শিশুকন্যার জন্মে তিনি পারিশ্রমিক নেন না। তাঁর কথায়, অনেকেই মনে করে রোগীমৃত্যুর খবর আত্মীয়দের জানানো একজন চিকিৎসকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু আমার কাছে কন্যা সন্তানের জন্মের পর সেই খবর যখন রোগীর আত্মীয়স্বজনদের জানানোও চ্যালেঞ্জের মতোই মনে হয়েছে বারবার।
যখনই কোনও গর্ভবতী মহিলা হাসপাতালে ভর্তি হয় তার বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন ভেবেই নেয়, অনাগত সন্তান পুত্রই হবে। কাজেই যখন কন্যার খবর জানানো হয় তারা অনেক সময় চিকিৎসকের সামনেই বিরূপ আচরণ করে।
ছেলে হলে বাজনাবাদ্য-মিষ্টি, আর মেয়ে হলে মুখ অন্ধকার- এটাই বাস্তব ছবি। এমন ঘটনাও তাঁর অদেখা নয় যেখানে মেয়ে হয়েছে সদ্য-মাকে একা ফেলে স্বামী, আত্মীয়রা ফিরে গিয়েছে। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও করেনি।
এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন ডাক্তার গণেশ রাখ। প্রতিবার যখন নতুন শিশুকন্যার জন্ম হয়, নবজাতক ও তাদের পরিবারের উপস্থিতিতে হাসপাতালেই আয়োজন করা হয় উৎসবের। গত চার বছরে ৪৬৪ কন্যাশিশুর জন্ম হয়েছে। এই হাসপাতালে শিশুকন্যার জন্ম মানেই উৎসব। সকলেই অংশগ্রহণ করেন সেই উৎসবে। নেপথ্যে পরবর্তী সময়ে এইসব শিশুদের বাবা-মা’রা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গিয়েছেন ডাক্তারবাবুকে। তাঁর সংস্পর্শে এসে জীবনের দিক বদলে গিয়েছে বহু মানুষের। পরিবারেরও।
এহেন ডাক্তারবাবু কিন্তু ‘চিকিৎসক’ হতে চাননি কেরিয়ারের শুরুতে। চেয়েছিলেন কুস্তিগীর। কিন্তু মায়ের আপত্তিতে সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি।
বড় বাধা আর্থিক সামর্থ্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা দোকানে মালবাহকের কাজ করতেন। মা গৃহসহায়িকা। কোথা থেকে আসবে ছেলেকে ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যয়।
কোনও রকমে তিন পুত্রের ভরনপোষণ কতেন বাবা-মা। তাই মন দিতে বলেছিলেন পড়াশোনায়।
চিকিৎসক হিসেবে শুরু করলেন কর্মজীবন। কিন্তু জীবনের লড়াই তাতে একচুলও কমেনি।
‘কন্যাশিশুর জন্ম হলে পারিশ্রমিক নেবেন না’- এই সিদ্ধান্ত যখন নিলেন তখন সরাসরি আপত্তি এসেছিল ঘনিষ্ঠ মানুষদের থেকেই। ভয় পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে।
সেই পরিস্থিতিতে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাবা। পুরোপুরি সমর্থন করেছিলেন পুত্রের সিদ্ধান্তকে। বলেছিলেন প্রয়োজনে তিনি আবার পুরনো পেশায় ফিরে যাবেন তবু বজায় থাকুক এই সিদ্ধান্ত।
ডাক্তার গণেশ রাখের কাজ প্রশংসা পেয়েছে সব মহলে। রাজ্য সরকার থেকে কেন্দ্র সরকারে। অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের কথায় তিনি ‘রিয়েল হিরো’।
এত প্রশংসা, এত সুনাম এসব কিন্তু বিশেষ প্রভাব ফেলে না তাঁর মনে। তিনি ফলে বিশ্বাসী। সেই জন্য ‘পারিশ্রমিক’ না নেওয়ার বিষয়টি তাঁর কাছে ‘সামান্য ব্যাপার’।
সাধারণ মানুষ তো বটেই সর্বস্তরে তিনি ‘কন্যাসন্তান জরুরী’ এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান। সেই লক্ষ্যেই ফুটপাতবাসীদের মধ্যে চেতনা তৈরির কাজ শুরু করেছেন সম্প্রতি।
তিনি চান বদলে যাক মানুষের ভাবনা। বদলে যাক মানুষের আচরন। মানুষ থেকে শুরু করে চিকিৎসক- সকলেরই। ডাক্তার গণেশ রাখ বলেন, “যে দিন মেয়ে হলেও মানুষ উৎসব করবে খুশিতে, সেদিন থেকে আমিও পারিশ্রমিক নিতে শুরু করব...না হলে হাসপাতাল চলবে কী করে!”