লোকসংস্কৃতির সেবক, ব্রাত্য লোকায়ত জীবনের ভাষ্যকার পুলকেন্দু সিংহ ফিরে গেলেন মাটির কোলে। বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভোর ৪ টে নাগাদ প্রয়াত হলেন মুর্শিদাবাদের এই লোক-গবেষক। গোরাবাজার শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। দীর্ঘদিন ধরেই নানা বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।
মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার অন্তর্গত আলুগ্রামে তাঁর জন্ম হয় ১৯৩৬ সালের ১৫ মে। সেই গ্রামে ছিল তাঁর মায়ের মামার বাড়ি। পুলকেন্দুর সিংহের মা ছিলেন পোলিও রোগী। সে জন্য তিনি মাতামহীর কাছেই মানুষ হন। পুলকেন্দুর পিতা সুধীর কুমার সিংহ ছিলেন সংসার উদাসী শিল্পী মানুষ। সঙ্গীত ও তবলা বাদনে বিশেষ পারদর্শী এই মানুষটি সংসারের খোঁজ রাখতেন না, খোঁজ রাখতেন না ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়েও। পুলকেন্দুর প্রথাগত পড়াশোনা তাই খুব বেশি দুর এগোয়নি। নিতান্ত কিশোর বয়সেই প্রবাদপ্রতিম জননেতা ত্রিদিব চৌধুরির বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে যোগ দেন আরএসপি দলে। পুলকেন্দু সিংহ একটা সময় জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিতও হয়েছিল। কিন্তু ‘প্রবাসী’র তত্ত্বাবধায়ক যোগেশচন্দ্র বাগল তাঁকে প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহিত করেন। কলকাতা থেকে মামার বাড়ি জামশেদপুরে বাউন্ডুলেপনা আটকাতে মামার কাছে পাঠিয়ে দেন মা। ততদিনে কবি হওয়ার স্বপ্ন পরিবর্তিত হয়েছে প্রাবন্ধিক হওয়ার স্বপ্নে। স্কুল ফাইনাল পাশ করে পুলকেন্দুবাবু বাল্যবন্ধু তুষারকান্তি চন্দ্রের সহযোগিতায় গ্রাম সেবকের চাকরি পান। ‘গ্রাম সেবক’ হিসেবে কাজ করার সুবাদেই গ্রামের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন খুব অল্প বয়সেই। পরবর্তী সময়ে সেই আগ্রহই তাঁকে লোকসংস্কৃতির গবেষক হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। মূলত তাঁর উদ্যোগেই বেশ কিছু লোকশিল্পী ভারত ও ভারতের বাইরে নিজের নিজের আঙ্গিকের লোকশিল্প পরিবেশন করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন।পুলকেন্দুবাবুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মুর্শিদাবাদ জেলার লোকসংস্কৃতি চর্চার পথিকৃত বললেও ভুল বলা হবে না। ‘ঝড়’, ‘বীক্ষণ’, ‘বোধোদয়’ প্রভৃতি স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সেই চেনা কথাই লিখে লিখে নাগরিক সমাজের সঙ্গে লোকশিল্পের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন তিনি।
জেলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে মুর্শিদাবাদকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুলকেন্দু সিংহ। গ্রাম সেবকের সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলার গ্রাম্য জীবনকে চিনেছিলেন। দরিদ্র মানুষের জীবন জীবিকার তথ্য অনুসন্ধানের সূত্রেই তিনি দরিদ্র লোকশিল্পীদের জীবন যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচিত হন। বহু অজ্ঞাত, অনাদৃত লোকশিল্প তাঁর লেখার সূত্রেই প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়েছে। তাঁর সক্রিয়তার কারণেই মুর্শিদাবাদের বহু লোকশিল্পী সম্মানিত হয়েছেন।
তাঁরই উদ্যোগে এবং গোবিন্দ বিদার্থীর নেতৃত্বে দিল্লির সংগীত নাটক একাডেমির প্রতিনিধি দল এসে মুর্শিদাবাদ জেলার স্থানীয় লোকশিল্পীদের বাউল, কীর্তন, পটের গান, মনসার গান, ভারবোল, আলকাপ, সাঁওতালি নৃত্যগীত প্রভৃতি দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে ধরে রাখেন। আর এই লোকশিল্পীদের সন্ধান দেওয়া থেকে শুরু করে, নির্দিষ্ট স্থানে তাদের নিয়ে যাওয়ার কাজটি সূচারুভাবে সম্পন্ন করেন পুলকেন্দু সিংহ। অসংগঠিত লোকশিল্পীদের সংগঠিত করে তাদের শিল্প প্রতিভাকে প্রচারের আলোয় আনার লক্ষে ১৯৭৫ সালে তিনি গঠন করেন “লোকায়ত শিল্পী সংসদ”। এই সংসদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপদেষ্টার পদ বিভিন্ন সময়ে অলংকৃত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী, শান্তিদেব ঘোষ, পান্নালাল দাশগুপ্ত, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ-এর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘মুর্শিদাবাদের লোকায়ত সংগীত ও সাহিত্য’। তাঁর লেখা অন্যান্য বইগুলো হল মহাজীবনের কবিতা (১৯৮২), লোকায়ত মুর্শিদাবাদ (১৯৮৫), স্থান কাল পাত্র (১৯৯১), পঞ্চায়েত ও লোকসংস্কৃতি (১৯৯৩), ফিরে চল মাটির গানে (১৯৯৮), মুর্শিদাবাদের লোকশিল্পী (২০০৩), লোকায়তিক শান্তদেব ও তার অপ্রকাশিত পত্রাবলী (২০০৩), মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র (২০০৬), মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতি (২০১৫), যাঁদের সান্নিধ্যে এসেছি(২০২০) ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদের নানান বৈচিত্রময় জনজাতীর আচার-আচরণ, জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, অর্থনীতির মনোজ্ঞ বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর ‘কালকেতুর আপন দেশে’ (২০১৮) বইটিতে। জেলার নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির পর্যালোচনাতেও তিনি অগ্রপথিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
তিনি শুধু লোকসংস্কৃতির চর্চাই যে করেছেন তা নয়। এর পাশাপাশি গল্প, কবিতাও লিখেছেন। নানা নামী- অনামী পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে তাঁর গল্প, কবিতা, প্রবন্ধের সম্ভার। তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুলকেন্দু অজস্র সম্মানে ভূষিতও হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফোকলোর তাঁকে সাম্মানিক ফেলোশিপ দেয়। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্যনাট্য ও সংগীত দৃশ্যকলা একাডেমি তাঁকে আচার্য্য দিনেশচন্দ্র সেন পুরস্কারে সম্মানিত করে। ২০১০-এ বাংলা একাডেমি তাঁকে তাপসী বসু স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত করে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বার্ধ্যক্যজনিত নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। বাইপাস সার্জারিও হয়েছিল। তাঁর মধ্যেও কাশিমবাজারের একচিলতে ঘরে বসেই তিনি একাগ্র চিত্তে তাঁর সাধনায় ব্রতী ছিলেন। অসমাপ্ত রয়ে গেল তাঁর বহু মূল্যবান গবেষণা। তার আগেই থেমে গেল সব কিছু। মৃত্যু থামিয়ে দিল তাঁর যাবতীয় সাধনা। শুধু তাই নয়, আক্ষরিক অর্থেই জেলার লোকসংস্কৃতি চর্চার একটা যুগের অবসান ঘটল।