লম্বা লাইন আর থিকথিকে ভিড়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, দুর্গা পুজোর প্যান্ডেল নাকি, জুতোর কেনার লাইন! ভিড়ে ভিড়াক্কার। এসি ঠাণ্ডা আউট লেটে ঘেমে নেয়ে একশা মানুষ। তবু খামতি নেই উৎসাহে!
পুজোর ঠিক মুখে মুখেই দারুণ ‘ভাইরাল’ হয় জুতোর এই ভিডিয়ো, নেটিজেনদের মজার মন্তব্যে নেট দুনিয়ায় ভরপুর পুজোর আমেজ। অনেকেই অবশ্য এই ভিড়ের বহরকে উৎসাহ না বলে হিড়িক বলছেন।
কিন্তু হিড়িকের প্রাণ যে উৎসাহ সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাঙালির পুজো শপিং শুরু হয় জুতোর দোকান থেকে। পুজোর মাস খানেক বাকি থাকতেই ফি রবিবার শপ।পুজোর বাজার করতে যাওয়ার প্ল্যান। বাঙালি বাড়ির এ এক পুরনো ট্র্যাডিশন।
তখনও পুজোর ‘কেনাকাটা’কে মানুষ ‘শপিং’ বলতে শেখেনি। খবরের কাগজের পাতায় বেরত জুতোর ক্যাটলগ। সঙ্গে সাইজ। একটা, কখনও তারও বেশি পাতা জুড়ে। সেদিন গোটা বাড়ির সবার হাতে হাতে ঘুরত কাগজ। বাড়ির সবচেয়ে খুদে সদস্য থেকে শুরু হত পায়ের মাপ নেওয়া ঝাঁটার কাঠি ভেঙে নেওয়া হত পায়ের ইঞ্চির মাপ। পায়ের যা মাপ তার থেকে কয়েক ইঞ্জি বাড়িয়ে নেওয়া হত মাপ। ব্যাক আপ পালনও থাকত। সাদা পাতার ওপর পা বসিয়ে এঁকে নেওয়া হত পায়ের ছবি। তারপর বাবা-মা কিংবা বাড়ির বড়দের হাত ধরে জুতোর দোকানে। সব সময় সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই কাঠি মাপ আর পায়ের ম্যাপ দেখিয়ে দোকান থেকে আসত নতুন জুতো। পুজোয় চাই নতুন জুতো বাটার এই বিজ্ঞাপন আজও পুজোয় জুতো কেনার ট্রেডমার্ক হয়ে আছে বাঙালি মনে।
জুতোর পর আসত জামার পালা। পুজোর চারদিন চাই চারটে জামা। সবচেয়ে ভাল জামা দুটো থাকত অষ্টমী আর নবমীর জন্য। চারদিনের চারটের পর যা জামা জমা হত, সবটাই বোনাস পাওনা। উপরি আনন্দ। আশি-নব্বইয়ের দশকে তখনও শপিং মল দেখেনি কলকাতা। নিউমার্কেট থেকে কেনাকাটা মানে মধ্যবিত্ত বাড়িতে বাড়তি গ্ল্যামার। প্রাইস ট্যাগ দেখে কেনা তো দুরস্ত। রেডিমেড জামাকাপড় ‘ট্রেন্ডে ইন’ হওয়ার আগে পাড়ার টেলারিং হাউসগুলো ছিল পুজোর স্বপ্নের কারখানা। বাড়িতেও দুপুরবেলা হাত মেশিন চলত ঘরঘড়িয়ে। মা, কাকিমা, দিদিরা যত্ন করে বানিয়ে দিত হাল ফ্যাশনের ফ্রক। নকসার ক্যাটলক বুক ও মিলত নিউমার্কেট অঞ্চলে। থান আসত সিল্ক, সুতির। সেই থান পাড়ার দোকানে দিয়ে পছন্দমতো ডিজাইনে তৈরী হত ফ্রক। গজ ফিতে দিয়ে মাপ নিতেন মাস্টার। বহুদিন পর্যন্ত বজায় ছিল এই কালচার।
এখন বদলে যাওয়া সময়ে এ সবই অলীক কাহিনি মনে হলেও এ গল্প মাত্র কয়েক দশক আগের অতীত। সাদামাটা মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে অঢেল বৈভবের সুযোগ ছিল না, কিন্তু যৌথ যত্নের আদর ছিল অপর্যাপ্ত।
সব কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থাকত অপেক্ষার দিন গোনা। জামা হাতে পাওয়ার দিন গুনতে গুনতে হিসেব চলত পুজোর আর কতদিন বাকি। পুজোর জামা দিতে বাড়িতে মামা-মাসি-জ্যেঠু-কাকার আসা যাওয়া। মোবাইল যুগ দুরস্ত, ল্যান্ড ফোনটাও তেমন হাতের কাছের জন নয় তবু সকলেই জানত এই উপহার বাদ পড়বে না কখনও।
এমন অপেক্ষা আজও কি অবশিষ্ট আছে, কী বলছে আমাদের সময় ?