"এটি শুধু আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সৃষ্টি নয়, এটি এ শতাব্দীর শিল্প ও বিজ্ঞানের নিদর্শন" দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। নাৎসি বাহিনী আক্রমণ করবে প্যারিস। অর্থাৎ সুরক্ষিত রাখতে হবে শহরের গর্বের স্তম্ভকে। তাই কেটে দেওয়া হল মিনারে ওঠার লিফটের তার। ফ্রান্সের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সাল,১৮৮৭। ফরাসী বিপ্লবের একশো বছর। তোড়জোড় চলছিল শর্তবাষিকী পালনের। ঠিক হলো তৈরি হবে এক স্মৃতি বাহক মিনার। তৈরির ভার পেলেন আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেল।
তবে জনগন চাইলেন না। শহরের নিজস্ব আবেগের পরিপূরক নয় এই মিনার। কারিগরও জনগণের দলেই। আধার যখন স্বপ্ন পূরণ, তখন যিনি তৈরি করবেন সেই স্বপ্ন, সেই স্থপতি কে তো রাজি হতেই হয়। সঙ্গ পেলেন ইঞ্জিনিয়ার মরিস আর কোয়েচেন ও এমিল নউগুইয়ার।কোনও এক অন্য সময়ের গল্প। আরেক স্বপ্ন দেখা পাগল। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ঈশ্বর যদি পৃথিবীতে আসেন আর এসে তাঁকে কিছু দিতে চান তো তিনি কী চাইবেন। " বড় সাধ একবার ওই উঁচু টাওয়ার টা যদি দেখতে পারতাম! "এই ছিল ওঁর উত্তর। ঈশ্বরও চিন্তায় ছিলেন এই বুঝি উল্টোপাল্টা কিছু চেয়ে বসে... কিন্তু না! ইনি চেয়ে বসলেন এক অদ্ভুত জিনিস। ঠিক জিনিস না। ইতিহাসের স্মৃতি বন্দী রাখার এক ম্যাজিক স্ট্যাচু। হ্যাঁ, এও সম্ভব মানুষের দ্বারাই।
তাঁর নাম আইফেল টাওয়ার। ছয় এপ্রিল বলা চলে তাঁর ইহলোকে জন্ম দিবস। ওইদিনই এই পৃথিবী প্রথম সাক্ষী থাকে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার। সুযোগ পায় স্বপ্নের মিনার ছুঁয়ে দেখার। সুযোগ পায় আকাশ এর কাছাকাছি একটু সময় কাটানোর। দুই বাহু ছুড়ে দিয়ে, বুক চিতিয়ে স্বপ্নের চূড়োয় একবার দাঁড়ানোর। ঠিকানা হতে চলেছে প্যারিসের চ্যাম্প ডি মার্স, শ্যেইন নদীর তীরে। এই হবে আগামীতে আন্তর্জাতিক মানব মেলার প্রবেশদ্বার। ত্রিশের দশক পর্যন্ত একার রাজত্ব ছিল পৃথিবীর উচ্চতম মিনার হিসাবে। দেশের জাতীয় আয় একপ্রকার নির্ভর করে এই জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটের উপর।
৯০০ ফুট। আর হ্যা! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এখানে বসানো রেডিও স্টেশনটি জার্মান রেডিও সিগনালের সুচারু কর্ম পরিকল্পনায় কাজে লেগেছিল বিস্তর। কারণ বোঝাই যাচ্ছে। স্বয়ং হিটলার প্রেমে পড়েন এই মিনারের। পা পড়েছিল টাওয়ারের চূড়োয়। সরকার এই মুহূর্ত কে বেঁধে ফেলেন বিজ্ঞাপনী প্রচারের মাধ্যম হিসাবে। নানান যুগান্তকারী ঘটনায় আবৃত এই মিনার। নির্মাণ কার্যে রট আয়রন এর প্রাধান্য বেশি মাত্রায় থাকায় ঋতু অনুযায়ী তাপমাত্রার কমবেশি বদল হলে, বদলায় এর আকার। প্রভাব পড়ে ঝড়ো হাওয়াতেও।
নির্মাণ কারীরা প্রথমে জানিয়েছিলেন মাত্র দুই দশক দাঁড়িয়ে থাকবে এই মিনার। তারপর? তার আর পর নেই। দেশের আর্থিক শ্রী বৃদ্ধি আর বেতার তরঙ্গের সহায়ক হিসেবে আজ এক শতাব্দী পড়েও উজ্জ্বল তাঁর উপস্থিতি। আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে উপরের অংশে কিছুটা গাঢ় রঙের ব্যবহার আছে। তবে নিচে নামতে নামতে হালকা হয়েছে রঙ। প্রত্যেক সাত বছর অন্তর নতুন রঙ পরে গায়ে। যেদিন খোলা হয়েছিল মিনারে ওঠার প্রবেশদ্বার, তখন প্রায় তিরিশ হাজার দর্শনার্থীকে ১,৬৬৫টি ধাপ পেরিয়ে উঠতে হয় শীর্ষে। স্বপ্ন ছুঁতে গেলে যে সামান্য বড়ো যাত্রায় অংশ নিতে হবেই এবার। আজ অন্যান্য দেশেও গড়ে উঠেছে এর রেপ্লিকা।
শুভ জন্মদিন প্রিয় আইফেল... টাওয়ার।