১৯০৫ এর ৬ই জুলাই। কলকাতা প্রেসে প্রকাশিত হয় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের খবর। প্রথমবার। তবে এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বীজ গোপনে অঙ্কুরিত হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলাকে অতিরিক্ত বৃহৎ মনে হতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকারের। সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা চালানো নাকি দুরূহ হয়ে পড়েছিল তাঁদের কাছে। এমনটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের যুক্তি। তাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাংলার অন্তরে তখন প্রতিবাদে স্রোত বইছে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত সকলেই। সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢাললো বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রকাশিত হওয়ার পরই ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'দ্য বেঙ্গলি' পত্রিকায় লিখলেন "এটি একটি ভয়ঙ্কর জাতীয় বিপর্যয়"। তিনি সকল বাংলা বাসীকে এর বিরুদ্ধে একত্রিত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সময় থেকে শুরু হয়েছিল এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
শুরুর গল্পটা একটু শোনা যাক। ১৯০২ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিন্সের লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজার বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বাদ দিয়ে ওড়িশা ও সম্বলপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। তৈরি হয় খসড়া প্রস্তাব। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের অঙ্কুরিত হওয়ার সূত্রপাত এখানেই। লর্ড কার্জন এই অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে বাংলার গভর্নর অর্থাৎ ছোটলাট নিযুক্ত করেন। তাঁর উপদেশেই কার্জন বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের পূর্ণ প্রস্তাব ঘোষণা করেন ১৯০৫ সালের ১৯শে জুলাই। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, মালদহ, পার্বত্য ত্রিপুরা,অসম নিয়ে গঠিত হল পূর্ববঙ্গ ও অসম প্রদেশ। এই নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী স্থির হয় ঢাকা। অন্যদিকে কলকাতাকে রাজধানী করে অবশিষ্ট বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে একত্রিত করে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ। এই ভাবেই বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক অজুহাতে। তবে মূল লক্ষ্য ছিল বাংলায় বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গকে স্তিমিত করে দেওয়া। ব্রিটিশ সরকারের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের ফলে ব্রিটিশ সরকারের আশা ছিল ব্রিটিশ রাজত্ব বিরোধী সুসংহত বাংলার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়া।
কিন্তু ফল হল উল্টো। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সমগ্র বাংলা প্রদেশ। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। সরকারিভাবে ঐ দিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তার আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মিছিল। জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলনের ঝড়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যাশা খড়কুটোর মতো উড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি"। যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিচিত হয়। ১৬ই অক্টোবরের দিনটিকে বেছে নেওয়া হল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কার্যকলাপের অন্যতম দিন হিসেবে। পালিত হল অরন্ধন দিবস। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, বাংলার কোন মানুষ সেদিন এক কণা অন্ন মুখে তোলেনি। ওই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সেদিন বাংলার প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরকে রাখি পরিয়ে সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা পৌঁছে দেন। পালিত হয় রাখি বন্ধন উৎসব। চারিদিকে চলতে থাকে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন। সমগ্র দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, কৃষ্ণ কুমার মিত্র, অম্বিকাচরণ মজুমদার এর নেতৃত্বে গৃহীত হয় নানা কর্মসূচি। ১৬ই অক্টোবর অনশনরত সমস্ত বাঙালি খালি পায়ে পথ পরিক্রমা😭 করে গঙ্গা স্নান করেন। এই স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ বাঙালির জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অংশ ছিল বয়কট। রজনীকান্ত সেনের গান "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই" স্বদেশী আন্দোলন ও বয়কটের কর্মসূচিকে উজ্জীবিত করেছিল। এসব গানের সুরের মাধ্যমে বিপ্লবের বার্তা মানুষের আত্মা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। বৃটিশ সরকারের কাছে এই আন্দোলন বিভীষিকার মত হয়ে উঠেছিল। এদিকে বাংলাভাষীরা অপেক্ষা করেছিল শেষের আলোটুকুর জন্য। অবশেষে সেই আলো ধরা দিয়েছিল। ১৯১১ সালে আন্দোলনের চাপে কার্যত পিছু হঠে ব্রিটিশ সরকার। রদ হয় বঙ্গভঙ্গ।