'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' - শ্লোগান তুলতে অহিংস গান্ধীজিকে অপেক্ষা করতে হল বেয়াল্লিশের 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' - অব্দি; কিন্তু, সহিংস বিপ্লবীদের শুরু থেকেই মূল মন্ত্র ছিল, 'করব নয়তো মরব!' ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর একুশ বছরের বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সেটাই কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন।
চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রীতিলতার জন্ম। ১৯১১ সালের মে মাসের ৫ তারিখে। ভালো নাম 'প্রীতিলতা', ডাক নাম 'রানি'। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে তখনো মেয়েদের 'লেখাপড়া শিখলেও হয়, না - শিখলেই বা কী' গোছের ব্যবস্থা। কিন্তু, রানি সেই ব্যবস্থায় বাঁধা পড়েননি। দাদাকে বাড়িতে পড়াতে আসতেন গৃহশিক্ষক, তাঁর পড়া শেষ হওয়ার আগে থাকতেই বই নিয়ে অপেক্ষা করতেন ছোট্ট রানি। দাদা উঠলেই মাস্টারমশাইকে ওঠার সুযোগ না - দিয়ে তিনি ঝপ করে বই নিয়ে বসে পড়তেন তাঁর সামনে। রানির পড়াশুনোর এই উৎসাহ দেখে ভালোমানুষ মাস্টারমশাই আরও আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন; পাশে এসে দাঁড়ালেন মা প্রতিভাময়ী। কাজেই সব বাধা দূরে ঠেলে সাত বছরের রানিকে স্কুলে ভর্তি করা হল।
ছাত্রী হিসেবে রানি অসম্ভব ভালো, ভবিষ্যৎ দারুণ সম্ভাবনাময়। ১৯৩০ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলেন। পড়তে এলেন কলিকাতায়, বেথুন কলেজে। তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম হলেন এবং বৃত্তি পেলেন। কিন্তু, ১৯৩২ সালে ইংরেজিতে অনার্স কমপ্লিট করতে পারলেন না, ডিস্টিংশনে বিএ পাশ করলেন মাত্র। এই না - পারার মধ্যে কোন অক্ষমতা ছিল না, ছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য সবকিছু, এমনকি তাঁর প্রিয় পড়াশুনোকেও উপেক্ষা করার ইচ্ছে। কারণ, ততদিনে তিনি চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সক্রিয় স্বাধীনতাকর্মী। তখনো অবশ্য গুপ্ত সদস্য। তাই পরিচয় গোপন রাখতে বিএ পাশ করেই চট্টগ্রামে নন্দনকানন গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার চাকরি নিলেন।
বিপ্লবীদলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে মেয়েদের নেবেন কি না, এই নিয়ে সূর্য সেনের অনেক দ্বিধা ছিল। মেয়েরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কোন অপারেশনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি না, দায়িত্ব নিতে পারবেন কি না, অমানুষিক কষ্ট সহ্য করতে পারবেন কি না, একই দলে ছেলেমেয়ে থাকলে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক তৈরি হয়ে আসল উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যাবে না তো!--এইরকম সাতপাঁচ নানারকম দ্বিধা। তা সেইসব দ্বিধা যখন ঘুচল, তখন দলভুক্ত হলেন রানি অর্থাৎ প্রীতিলতা এবং তাঁর সহপাঠী কল্পনা দত্ত। দেশের জন্য নিজের জীবন দিতে কিংবা অন্যের জীবন নিতে কখনও পিছপা হবো না! এই ছিল প্রীতিলতাদের জীবনপণ! প্রীতিলতা ভেবেইছিলেন জীবনে যদি সুযোগ আসে, তাহলে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারদার সমস্ত দ্বিধা দূর করে, মেয়েরা যে চাইলেই সব পারে, ছেলেদের তুলনায় তাঁরা যে কোন অংশেই কম নন, এটা প্রমাণ করে দেবেন।
সেই কিশোরীবেলা থেকেই প্রীতি চট্টগ্রামে থাকতে দেশপ্রেমী কিশোরী - সংগঠন লীলা নাগ - এর 'দীপালি সংঘ' এবং কলিকাতায় থাকতে কল্যাণী দাস - এর 'ছাত্রী সংঘ'-র হয়ে কাজ করার সময় কতবার মাস্টারদার নাম শুনেছেন, তাঁর সংগ্রামের কথা শুনেছেন, মনে মনে তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন, তাঁকে নিজের নেতা হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন। কিন্তু, কই তাঁর সঙ্গে তো এখনও দেখা হল না! মাস্টারদা তখন পুলিশ ও জনসাধারণের কাছে ফেরার। তাঁর মাথার দাম, দশ হাজার টাকা। প্রীতি তখন গোপনে বিপ্লবী ও বিপ্লবীসংগঠনের মধ্যে গোপন খবর আদানপ্রদানের মাধ্যম। পুলিশ ইন্সপেক্টর তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার আসামি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে তিনি বোন সেজে প্রায় চল্লিশ বার সাক্ষাৎ করলেন, খবর দেওয়া - নেওয়ার জন্য। কিন্তু, তারপর দেখা করতে গিয়ে যেদিন হঠাৎ শুনলেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি হয়ে গেছে, সেদিন তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এই তাহলে বিপ্লবীর জীবন! অমনি নিজের জীবনের দিশা ঠিক করে ফেললেন লড়বেন, সম্মুখসমরে লড়বেন; মরবেন, লড়াই করে মরবেন!
১৯৩২ সালের কথা। ধলঘাট গ্রামের বিধবা সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন সূর্য সেন, নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। কল্পনা ভাগ্যবতী, তাঁর সঙ্গে বহু আগেই সূর্য সেনের সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রীতির ভাগ্য খুলল কল্পনার হাতেই। কারণ, তিনিই পুরুষের ছদ্মবেশে প্রীতিকে নিয়ে এলেন সাবিত্রীর বাড়িতে। সেভাবেই প্রিয় মাস্টারদাকে এই প্রথম চোখের দেখা দেখলেন প্রীতি। শ্রদ্ধা জানালেন। আলাপ হল। এরপর থেকে মাস্টারদার আদেশ ও উপদেশ নিতে মাঝেমাঝেই এ-বাড়িতে প্রীতির আসাযাওয়া শুরু হল। এবং, ব্যাপারটি পুলিশের কানে উঠতে দেরি হল না।
১২ জুন (মতান্তরে, ১৩ জুন) রাতে পুলিশ ঘেরাও করল সাবিত্রীর বাড়ি। বাড়িতে তখন তিন ফেরারির সঙ্গে প্রীতিলতাও মজুত। শুরু হল গুলির লড়াই। মাস্টারদা ও প্রীতি পালাতে পারলেও নির্মল ও অপূর্ব সেন মারা গেলেন পুলিশের গুলিতে। প্রীতির বাড়িতে শুরু হল পুলিশের উৎপাত। ফলে, তাঁকেও ফেরার হতে হল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথার দামও ধার্য হয়ে গেল, পাঁচশো টাকা।
ফেরারি জীবন প্রায় তিন মাস ছুঁতে চলল। কিন্তু, প্রীতির কেবলই মনে হতে লাগল, পালিয়ে বেড়িয়ে শান্তি নেই। মাস্টারদাকে জানালেন যে, সম্মুখ সমরে যেতে চান তিনি, মাস্টারদা যেন এবার তাঁকেই নেতৃত্বের ভার দেন। এই ফেরারি জীবনে প্রীতি যেমন মাস্টারদার সান্নিধ্য পেয়েছেন, তেমনি মাস্টারদাও তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলেন। প্রত্যয়ের পরিচয় পেলেন। ফলে, ইচ্ছেপূরণের জন্য প্রীতিকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না।
পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব, পদস্থ সাহেব ও মেমদের একটি কুখ্যাত প্রমোদক্লাব। ক্লাবের গেটের বাইরে লেখা একটি অত্যন্ত অপমানজনক কথা 'কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ'। তার ওপর এদেরই নির্দেশে পুলিশ পাহাড়তলীর মানুষের ওপর অকথিত অত্যাচার করে। এর শোধ নিতে হবে। সেইসঙ্গে শোধ নিতে হবে গোটা দেশে ইংরেজের অসহ্য অত্যাচারের। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ দু'বার ব্যর্থ হয়েছে। এই দুবার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই পুরুষ। এবার সামনে দুর্গা পুজো, ঠিক হল, এই তৃতীয়বারের নেতৃত্বের ভার দেওয়া হবে প্রীতিকে। তিনি দশভুজার বলে বলীয়ান হয়ে এই অভিযান অবশ্যই সফল করবেন!
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যেবেলা। দেবী কালিকার পুজো করে অপারেশনের নেত্রী প্রীতিলতার হাতে সূর্য সেন তুলে দিলেন দুটি অস্ত্র, রিভলবার ও পটাশিয়াম সায়ানাইড। তারপর একে একে বোমা এবং রিভলবার তুলে দিলেন প্রীতির সঙ্গী জনা - বারো বিপ্লবীর হাতে। দেবী কালিকার আশীর্বাদ ও মাস্টারদার শুভেচ্ছা নিয়ে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে বাহিনী পৌঁছে গেল ক্লাবের সামনের ঝোপঝাড়ে গা ঢাকা দিয়ে। অল্প একটু অপেক্ষার পর যখন দেখা গেল সবাই মদ ও নৃত্যে মগ্ন, তখনই প্রীতির নির্দেশে শুরু হল বোমা-গুলির অতর্কিত আক্রমণ। গুলি ও বোমা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাহিনী ঢুকে পড়ল ক্লাবের ভেতরে। মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল প্রমোদ বিলাসীরা। শুরু হল ভয়ার্ত ছোটাছুটি। সেইসঙ্গে পাল্টা গুলির আক্রমণ। তারই মধ্যে বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হল ষোলজন ইংরেজ। কিন্তু, বিপ্লবীরা সকলেই প্রায় অক্ষত রইলেন। পালাতেও সক্ষম হলেন। শুধু প্রীতির হাতে লাগল বুলেটের আঘাত। তিনি পড়ে গেলেন। তারপরও হয়তো তিনি পালাতে পারতেন, কিন্তু, পালালেন না। ধরাও দিলেন না। তৃতীয় অভিযান সফল দেখে তিনি মুখে দিলেন সায়ানাইড। প্রমাণ করে দিলেন, দেশের জন্য তিনি প্রাণ নিতে যেমন পারেন, তেমনি পারেন অনায়াসে প্রাণ দিতেও! 'তিনি' মানে, 'মেয়ে-নারী-মায়েরা'। 'তিনি' মানে, 'দেশ'। তাই হয়তো মৃত্যুর সময় তাঁর প্রশান্ত ঠোঁটে লেগে রইল এক চিলতে তৃপ্তি 'মাস্টারদা, আমি পেরেছি, না?'
তথ্যঋণ: 'স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী' - কমলা দাশগুপ্ত ও 'প্রথম বিপ্লবী নারী শহিদ প্রীতিলতা' - চিন্ময় চৌধুরী।