“আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ। ব্রিটিশরা জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং, তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারী কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে কোনো বাধা বা অন্তরায় যে কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
-মরদেহ পোস্ট মর্টেম করার সময়ে তাঁর সামরিক পোশাকের মধ্যে নিজ হাতে লেখা একটি বিবৃতি বের হয়ে আসে। উপরিউক্ত পরিচ্ছেদ তারই অংশবিশেষ। অত্যন্ত যত্নে তিনি এটিকে অন্য একটি কাগজে মুড়ে পোশাকের ভিতরে রেখে দিয়েছিলেন। বেশ বড়সড় একটি বিবৃতি এটি। বেশ ভেবেচিন্তেই তিনি বিবৃতিটি লিখেছিলেন। দেখিয়েছিলেন সূর্য সেনকে। সূর্য সেন পড়ে অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এই বিবৃতিটি পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি জানতেন, এই আক্রমণের পরে তাঁর জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সে কারণেই শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম’। বিবৃতিটি সরকারী পক্ষ আদালতে হাজির করেছিল।
প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার। নিজের প্রতিটা মুহূর্ত যিনি ব্যয় করেছেন স্বাধীনতার বৃহৎ স্বার্থে। তিল তিল করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে। তাঁর আত্মাহুতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, নয় কোনো দুর্ঘটনা। আত্মাহুতির জন্য নিজেকে ঘষে মেজে অনেক যত্নে তৈরি করেছেন তিনি। প্রীতিলতা নামের এক অসম সাহসী, অসীম দেশপ্রেমী তরুণীটির এই অসামান্য আত্মত্যাগ এবং অকাতর আত্মোৎসর্গকে বোঝার মত উপলব্ধি প্রজন্মের আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট। যাই হোক, মেয়ে হয়েও দেশোদ্ধারে নেমেছিলেন, সে প্রসঙ্গেও জীবত অবস্থায় দিয়ে গিয়েছিলেন কৈফিয়ৎ-
“আমি মনে করি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ এখনও হয়ত আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁহারা বলিবেন যে – ভারতীয় নারীত্বের ঊর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মত এই ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল।
দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরূপ কত নারীর বীরত্বগাথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃংখল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?
নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন – এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”
প্রীতিলতার মৃত্যুদিবস চব্বিশে সেপ্টেম্বর। উইকি ঘাটলে একাধিক জায়গায় ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন ও তাঁর মৃত্যুদিবস লেখা হয়েছে তেইশে সেপ্টেম্বর। প্রীতিলতার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন কল্পনা দত্ত। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে প্রীতির সাথে কল্পনাও সহযোদ্ধা হিসাবে থাকতেন, যদি না তিনি ধরা পড়তেন এই ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহ আগে। সেই কল্পনা দত্ত তাঁর নিজের বইয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিনক্ষন কত ছিল তা জানাতে গিয়ে লিখেছেন,
24th September, 1932, was one such Saturday. The music, laughter and revelry came to a dead stop suddenly about 9 o’clock in the night.
এ ছাড়া এই বইতে আরেক জায়গায় লিখেছেনঃ
On the morning of the 25th of September the D.I.B. Inspector came to see me. He started off at once, “God, we saved you in the nick of time!” A little later, another official came and said, “It is our great, good fortune to have saved a girl like you from death.” What were they driving at? – the suspense made me crazy with impatience. The D.I.B Inspector came out with it finally. “Preeti died yesterday,” he said, “she raided Pahartali club and then took potassium cyanide. Thank God, we arrested you – or you would have gone the same way. Preeti was dressed exactly as you were.”
কল্পনা দত্তের বক্তব্যের পরে আর কোনো সন্দেহই থাকে না যে, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়েছিল চব্বিশ তারিখ রাতে এবং সেই রাতেই প্রীতিলতা আত্মাহুতি দেন।
পরাধীনতার যে গ্লানি তা প্রীতিলতারা টের পেয়েছিলেন হাড়ে-মজ্জায়-হৃদয়ে-জীবনে। তাঁদের আত্মাহুতি স্বাধীনতা দিয়েছিল আমাদের। তাই কোনও দায়বদ্ধতা থেকে নয়, নিজেদের অতীতচেতনা থেকেই এখনও শ্রদ্ধায় স্মরণে উঠে আসেন তাঁরা।