পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা, না পিংলা কোনো মহাদেশ নয়, পিংলা কোনো দেশ নয়, পিংলা কোনো রাজ্য নয়। কিন্তু পিংলার নাম আজ ভারতবর্ষ।
প্রণতির পিংলা বা পিংলার প্রণতি, আজ দুই-এ মিলে একাকার হয়ে গিয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল, নামটা শুনলেই মনে হয় এই বুঝি গোলাগুলি মারামারি শুরু হল, রক্তারক্তি কাণ্ড শুরু হবে। না! সেদিন আর নেই, আজ এই জঙ্গলমহলের পিংলাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছে ভারত। সেই স্বপ্নের নাম প্রণতি। ১৩০ কোটির স্বপ্নের নাম প্রণতি।
এক প্রত্যন্ত গ্রাম, ঠিক যেমন সবুজশান্ত গ্রাম আমাদের হলি ডে ডেসটিনেশন হয়, ঠিক তেমন। যেমনটা আমরা পর্দায় বা বইয়ের পাতায়, দেখতে বা পড়তে ভালোবাসি ঠিক তেমনই।
এই পিংলাই রোজ রাতে ঘুমাতে যেত স্বপ্ন নিয়ে, আর সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন এই পিংলাই ছুটতো স্বপ্নের পিছনে। আজ সেটা ভারতের স্বপ্ন। পিংলার স্বপ্নের নাম প্রণতি। শুধু স্বপ্ন নয়, সাহসের নামও প্রণতি।
যে খেলায় একচুল এদিক ওদিক হলে প্রাণ সংশয় হয়, নির্ঘাত মৃত্যু হয়, তাকে বশ্যতা স্বীকার করিয়েছে প্রণতি। সে সাহসের আরেক নাম না হয়ে থাকে কী করে ?
প্রণতি নায়েক, ঝাড়খন্ডে তাঁর জন্ম। পড়াশোনার জন্যে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের করকাই গ্রামে মামাবাড়িতে চলে আসনে প্রণতি। তারপর সেখানেই শুরু পড়াশোনা। এরও'পরে করকাইয়ে বাড়ি করে, স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান নায়েক পরিবার। তাঁর বাবা পেশায় বাস চালক। তাই ছোট বেলা থেকেই লড়াই আর জিতে যাওয়াকে, অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে প্রণতি। গ্রামের পুকুরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বড় হয়ে ওঠা তাঁর, গ্রামের বাড়ির দাওয়ায় বসে মুরি খেতে খেতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল সে।
সংসার চালানোর পরে তিন মেয়ের পড়াশোনা চালাতেই হিমসিম খেতেন প্রণতির বাবা। প্রণতির স্বপ্ন দেখার শুরু সেই ছোট্টবেলা থেকেই,
করকাই জনকল্যাণ শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়ার সময় শিক্ষিকা সন্ধ্যা মালাকার স্কুলের ছেলে মেয়েদের খেলাধুলোর জন্যে পাশের নাকপুরা গ্রামের জিমন্যাস্টিক্স প্রশিক্ষক শুভাশিস চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠান।
ছোট থেকেই কবাডি আর গুটি খেলতে খুব পছন্দ করতো প্রণতি। তার সঙ্গে যোগাসন ও জিমন্যাস্টিক ছিলোই। সব সময় দৌড় ঝাঁপ ও কার্টহুইল করা মেয়েটাকে বাড়ির লোকেরা জিমন্যাস্টিক্সে ভর্তি করে দিয়েছিল। সেই থেকে প্রণতির জিমন্যাস্টিক্স শেখার শুরু। কয়েক মাস সেখানে শেখার পরেই শুভাশিসবাবুর বাড়িতে গিয়ে অনুশীলন শুরু প্রণতির। শুভাশিস চক্রবর্তীই তাঁর প্রথম গুরু। শুভাশিসবাবুর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তেমাথানি মনসারাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় প্রণতি। স্কুলের শিক্ষক রাধাকান্ত শীটের প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় জেলা জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাজ্য জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সুযোগ পায় সে। প্রথমবার রাজ্য প্রতিযোগিতায় সফলতা আসেনি ওর।
কিন্তু সাই কমপ্লেক্সে ট্রায়ালের জন্য ডাক চলে আসে। জীবনের মোড় ঘুরে যায় পিংলার মেয়েটার।
২০০৩ সাল থেকেই সাইয়ে জিমন্যাস্টিক্সে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে সে।
স্কুলের শিক্ষক রাধাকান্তবাবু তাঁকে খুব সাহায্য করতেন। সেই সময় যুবভারতীতে বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ম্যানেজার স্বপন মজুমদার। কয়েক মাস পরে সাইয়ের জিমন্যাস্টিক্সের কোচ সাইয়ে হস্টেলের ব্যবস্থা করে দেন।
প্রণতির স্বপ্ন ছোঁয়ার এই লড়াইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সাই।
গত ১৮ বছর ধরে সাইয়ের প্রশিক্ষণেই রয়েছেন প্রণতি। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সাই প্রশিক্ষক মিনারা বেগমের কাছে, তিনিই আজ প্রণতির আদৰ্শ। সেদিনের সেই ছোটো মেয়েটির হাত ছাড়েনি মিনারা বেগম। আজ সেই ছোটো প্রণতি দেশের প্রতিনিধি, লক্ষ চোখের আশা ভরসা।
মিনারা বেগম অবসর নেয়ার পরে, এখন অবশ্য প্রণতি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সাই কোচ লখণ শর্মার কাছে। সাইয়ে থাকাকালীন সাই থেকে সমস্ত রকম সাহায্য পেয়েছেন প্রণতি, সাইয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম থেকে ফিজিওথেরাপি, কোচ সবই দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সেই কারণে পিংলার মেয়েটির সাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, প্রকাশ্যে সে বারবার জানায় সেটা। এরআগে ২০০৮ সালে প্রথম প্লেনে চড়ে রাশিয়া গিয়েছিল পিংলার মেয়েটা। মস্কোয় আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্সে ভল্ট ইভেন্টে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিল সে। তারপর কমনওয়েলথ গেমস, ২০১৯ সালের উলানবাটারে অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপেও ব্রোঞ্জ পদক জিতে দেশকে গর্বিত করেছিল পিংলার মেয়েটা। আগামীকাল ২৩ শে জুলাই অতিমারি পেরিয়ে শুরু হতে চলেছে, দ্যি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। সেখানেই ডাক পেয়েছ আমাদের ঘরের মেয়েটা। আমাদের মেয়েটা আজ ১২৬ জন ভারতীয় অ্যাথলিটের মধ্যে একজন। স্বপ্নে বিভোর পিংলা আর পিংলার মতোই গোটা ভারতও স্বপ্নে বিভোর, সে স্বপ্নের নাম প্রণতি। ১৩০ কোটির প্রত্যাশা পূরণে নামবে সে, বাংলা থেকে প্রথম ও ভারত থেকে দ্বিতীয় জিমন্যাস্ট হিসেবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার অনন্য কৃতিত্ব স্পর্শ করবে পিংলার মেয়েটা। বুক বাঁধছে দেশ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী প্রহর গুণছে।
যে স্বপ্ন নিয়ে প্রণতি প্রথমবারের জন্যে শূন্যে লাফ দিয়েছিল, সেই স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় আজ দাঁড়িয়ে সে। এবার আবার শূন্যে মৃত্যুভয় জয়করা একটা লাফ দেবে সে, এবার বিদেশের মাটিতে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর লক্ষ্য থাকবে তাঁর। আমরা গোটা দেশ তাকিয়ে থাকবো প্রণতির জয়, দেখবো বলে। আজ পিংলা থেকে টোকিওর স্বপ্নউড়ানের নাম প্রণতি, আজ ভারতবর্ষের নাম পিংলার প্রণতি।