বাবা ছিলেন রসায়নবিদ। ল্যাবরেটারিতে কেমিক্যালের সঙ্গে কেমিক্যাল মিলিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশা তাঁর। মায়ের অবসর ক্যানভাসে। রঙের সঙ্গে রঙমিলন্তি খেলায়। তিনি এসবের কোনওটাতেই যাননি। তবু রঙ আর রসায়ন প্রভাব ফেলেছিল তাঁর জীবনে। গন্ধে-বর্ণে-স্বাদের নেশায় বিভোর থেকেছেন আজীবন।
চিরকালের অবহেলার, হেলাফেলার ঘরটিই ছিল তাঁর ল্যাবরেটারি। স্বাদের সন্ধানে সেখানেই চলত গবেষণা। তেল-কালি-মশলার রাজত্বে আপাত ব্রাত্য ঘরখানি আসলে যে শিল্পের আঁতুড়ঘর। এই বোধ তিনিই প্রথম জাগিয়েছিলেন। কুটনো-বাটনা-খুন্তি নাড়া লোকনজরে ‘যেমন-তেমন’ কাজ। সেই কাজেই যে কী অসীম মেধা, মনন লুকিয়ে আছে তার ফসল তাঁর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’। বাংলার প্রথম পূর্নাঙ্গ রান্নার বই।
প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পূর্ণিমা দেবীর মধ্যম কন্যা। তিনি অন্তরালের, অবহেলার রান্নাঘরকে নিজের করে নিয়েছিলেন। আঠারো শতকের নিরিখে যাকে প্রায় বিপ্লব বলা যায়। হেমেন্দ্রনাথ নিজে রান্না করতে ভাল বাসতেন। রান্নাকে মনে করতেন কলাবিদ্যা। কন্যার ওপর তার পূর্ণ প্রভাব পড়ে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের মতো তিনিই বহুমুখী বিদ্যার অধিকারীনি ছিলেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন রান্নাকেই।
শুধু ভাল রান্না না, রান্না যে আসলে শিল্প, ছবি আঁকা, গান, নাটকের মতো স্বাধীন আর্টফর্ম সেভাবেই রান্নাকে উপ্সথাপিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেক নতুন রান্নার পদ আবিষ্কার করেছিলেন।
অহমিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়। সালটা ১৮৯১ সালের ১১ই মার্চ। প্রজ্ঞাসুন্দরীর মতই ভারী অন্যরকম তাঁর বিয়ের গল্পও। প্রজ্ঞাসুন্দরীর ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন লক্ষ্মীনাথ।একে পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবার, তারওপর মেয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত; সেই মেয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আপত্তি তুলেছিলেন তাঁর আত্মীয় স্বজন। কিন্তু সেই সব নিষেধ-বাধা উপেক্ষা করে তিনি প্রজ্ঞা দেবীকে বিয়ে করেন।
ঠাকুর বাড়ির অলিন্দ ছেড়ে বিয়ের পর তিনি আসাম চলে যান। স্বামীর কর্মসূত্রে তাঁকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বিভিন্ন অংশে থাকতে হয়। যে অঞ্চলে যেতেন সেখানকার রান্না শিখে নিতেন। নতুন স্বাদের বিবরনে ভরে উঠত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা।
১৩০৪ বঙ্গাব্দে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের উদ্যোগে ‘পুণ্য’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।মূলত হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র-কন্যারা অর্থাৎ প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবীর ভাইবোনেরা মিলে এই পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তার সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজে।
সেই পত্রিকাতেও রান্না নিয়ে নিয়মিত লিখতেন তিনি।
শুরু থেকেই আমিষ আর নিরামিষ রান্নার পদ্ধতি প্রকাশিত হতে থাকে এই পত্রিকার পাতায়। রান্নার পদ্ধতি তো থাকতই, সঙ্গে বাজারদরটিও দেওয়া থাকত।
ব্রিটিশ ভোজ সভার মত বাংলাতেও মেনুকার্ড প্রথা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি। ইংরেজি ‘মেনুকার্ড’- এর বাংলা নাম রাখলেন ‘ক্রমণী’। প্রজ্ঞা ভাবলেন তিনিও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্য ‘ক্রমণী’র ব্যবস্থা করবেন। ছাপা ‘ক্রমণী’ যদি অতিথিদের হাতে হাতে বিলি করা নাও যায়, তাহলে তা হাতে লিখে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলেও হবে| ভোজে কি কি পদ থাকবে, কোন পদের পর কোন পদ আসবে কিংবা কেমন করে লিখলে তা শিল্পসম্মত হয়ে উঠবে সে কথাও তিনি ভেবেছেন|
কলাইশুঁটি দিয়া ফেনসা খিচুড়ি
পলতার ফুলুড়ি
বেশন দিয়া ফুলকপি ভাজা
কাঁচা কলাইশুঁটির ফুলুড়ি
পেঁয়াজকলি ভাজা
ভাত
ছোলার ডালের দুধে মালাইকারী
বাঁধাকপির ছেঁচকি
তেওড়া শাকের চচ্চরি
কচি মূলার ঘন্ট
লাল শাকের ঘন্ট
বাঁধাকপির ঘন্ট
গাছ ছোলার ডালনা
মটর ডালের ধোঁকা
কমলানেবুর কালিয়া
ওলকপির কারী
পেঁয়াজের দোলমা আচার
ফুলকপির দমপোক্ত
বেগুন দিয়া কাঁচা কুলের অম্বল
আনারসী মালাই পোলাও
ফুলিয়া
প্রজ্ঞার ক্রমণীতে থাকতো ফরাসি কায়দায় ইচ্ছা নির্বাচনের সুযোগও তাই বোধহয় তার ক্রমণীও হতো বেশ দীর্ঘ|
‘পুণ্য’ পত্রিকা প্রকাশের ঠিক তিন বছর পর অর্থাৎ ১৩০৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই । ইংরেজী মতে ১৯০২ সাল। ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ (প্রথম খণ্ড)। রান্না নিয়ে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই। দ্বিতীয় বইটি বের হয় ‘আরও নিরামিষ’ নামে।
সম্পূর্ণ আমিষ রন্ধন প্রণালী নিয়ে তার তৃতীয় বই প্রকাশিত হয় ১৩১৪ সালে।
বাছাই করা আমিষ ও নিরামিষ খাবার নিয়ে তার আর একটি বই বের হয় ১৩২১ সালের চৈত্র মাসে। শুধু বাংলা ভাষা নয়, অহমিয়া ভাষাতেও রান্নার বই লিখেছিলেন।
‘রন্ধা-বঢ়া’ ও আচার চাটনি সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় ‘জারক’।বইটি প্রজ্ঞা উৎসর্গ করেন তার অকালপ্রয়াতা মেয়ে সুরভির নামে। বাঙালি রান্নার অভিধানে বহু নতুন শব্দের সংযোজন করেছিলেন প্রজ্ঞা দেবী। যা একেবারেই নতুন। সংস্কৃত বা অন্য ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ নয়। রান্না ঘরে চলিত বাংলায় যে সব শব্দ ব্যবহার করা হয় সেই সমস্ত শব্দ আভিধানিক রূপ পেয়েছিল। বাঙ্গালায় তিনিই প্রথম সার্থক রন্ধন গবেষক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫০ বছরের জন্মদিনে স্পেশাল ‘কবি সম্বর্ধনা বরফি’ তৈরি করেছিলেন। অতিথিরা খেয়ে মুগ্ধ। কেউ খেয়ে বুঝতেই পারেনি যে ক্ষীর নয়, ছানা নয়, এ বরফি আসলে ফুলকপি দিয়ে তৈরি। এভাবেই রামমোহন দোলমা পোলাও। দ্বারকানাথ ফির্নিপোলাও। নিজের অকাল প্রয়াত মেয়ের নামে ‘সুরভি’ পায়েসের নামকরণ করেছিলেন।
ঠাকুর বাড়ির অন্য মহিলাদের নিয়ে যতটা চর্চা হয়, প্রজ্ঞাসুন্দরী ঠিক ততটাই নেপথ্যে। এমনকী রবীন্দ্রনাথও তাঁর ব্যাপারে নীরব থেকেছেন। কিন্তু প্রজ্ঞাসুন্দরীর যে কোনও কাজে তাঁর স্বামী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর আধ্যাত্মিক জীবনে চলে যান। রন্ধন সাহিত্যের জগত আর সেভাবে পায়নি তাঁকে।
১৯৫০ সালে তাঁর জীবনের পাকশালার সমস্ত রসদ নিয়ে চলে যান প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী।