২১শে ডিসেম্বর, ১৯৭৪ দিনটা পাল্টে দিয়েছিল প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের জীবন। একজন থিয়েটারের অভিনেতা, যে কখনও থিয়েটারেও কোন নায়কের চরিত্রে কাজ করেনি, সেই দিনের পর সেই হয়ে উঠেছিল সিনেমার নায়ক
অনেকের মতে সত্যজিৎ রায় নির্মিত, কলকাতা ট্রিয়োলজির সেরা সিনেমা 'জন অরণ্য'। এক আড্ডায় প্রদীপ মুখোপাধ্যায় নিজেই বলেছিলেন, "কলকাতা ট্রিয়োলজির তিনটে গল্প তিন ধরণের। ‘সীমাবদ্ধ’র সেগমেন্টটা আলাদা। আর তাছাড়া আমার অভিনয় করার শখটা বহুদিন আগেকার। একবার বম্বেও চলে গেছিলাম। তখন একটা থিয়েটার দলে অভিনয় করি। কিন্তু নায়কের কোন চরিত্র বা বড় কোন চরিত্র নয়। ওটাকে নেগ্লিজিবেল বলা যায়। ইট ইস মানিকদা মেক মি শো... আমি খুব সিগ্নিফিকেন্ট অ্যাক্টর ছিলাম না। মানিকদার কেন জানি না মনে হয়েছিল আমি পারবো। আসলে চিরকালই আমি খুবই লো প্রোফাইল অভিনেতা। আর গ্রুপ থিয়েটারের ব্যাপারে গ্রুপিজিম একটা থাকে। আর তখন ছিল দিনান্তে এসে থিয়েটার করা। চাকরীর পর গিয়ে থিয়েটার করতাম। তখন থিয়েটারে তিনটাকা চারটাকার টিকিট হতো। এখন মানুষ তো একশো টাকা দিয়ে থিয়েটারের টিকিট কাটে। মানুষের কাছে টাকা এসেছে। কিন্তু বেসিক হাহাকারটা একই থেকে গেছে।"
'জন অরণ্য' সিনেমায় তিনি নায়ক, তিনি নতুন। আর তাঁকে ঘিরে সেই সময়ের সব দিকপালরা। উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সত্য বন্দোপাধ্যায় (পি এল টি), সন্তোষ দত্তর মতো অভিনেতা। এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "অভিজ্ঞতা অন্যরকম। তবে, কোনদিনই অসুবিধা হয়নি। ক্রিকেটে একটা কথা আছে, বোলারকে দেখোনা, বলটা দেখো। তাতে ব্যাট করতে সুবিধা। প্রথমে স্ক্রিন টেস্টের সময় আমার সহ অভিনেতা ছিল রবি ঘোষ। তার আগে মানিকদার আড্ডায় ওঁর সঙ্গে বেশ একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। রবিদার সঙ্গে কাজ করতে হবে শুনে রিঅ্যাক্ট দেখে মানিকদা বলেছিলেন, 'কেন? রবির সাথে তো তোমার খাতির হয়ে গেছে। তাহলে? ছবিতে তো তোমরা একসঙ্গে অভিনয় করবে। তখন ভয় পেলে চলবে?' আবার উৎপল দত্তের সঙ্গে প্রথম দেখা মেকআপ রুমে। উনি বললেন, 'এস সোমনাথবাবু। আজ থেকে কদিন তুমি ও আমি মুখোমুখি ঐ মহান মানুষটির ক্যামেরার সামনে'। সত্যজিৎ রায় নিজে শিল্প স্বাধীনতা ও শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন।"
সত্যজিৎ রায় ডিটেলিং-এ নজর দিতেন একথা বার বার শোনা গেছে বহু মানুষের কাছে। 'জন অরণ্য'র সোমনাথের মুখেও সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল সেদিন। তাঁর চুলে আগে মাঝে সিঁথে থাকত। সত্যজিৎ রায় পরে তা বদলে সাইডে করে দেন। শুটিং-এর সময় প্রায়ই তা আগের অবস্থায় ফিরে আসত। সত্যজিৎ রায় নিজের পকেট থেকে ছোট চিরুনি বার করে আবার প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের চুল 'সোমনাথের' মতো করে দিতেন। সিনেমার নায়ক জানান সেই সময় পরিচালক নাকি বলতেন, "সকলের চুলের প্যার্টান বদলে দিলাম, কেবল তোমাকে বাগে আনতে পারলাম না।"
প্রথমে নাকি জনঅরণ্য উপন্যাস ভালো লাগেনি পর্দার সোমনাথের। উপন্যাস হিসাবে আগে পড়ে থাকলেও তাঁর মনে ধরেনি। বিশেষ করে শেষ দিকটা। এমনি শংকরের লেখা খুবই ভালো লাগতো প্রদীপবাবুর । মধ্যবিত্তের একটা টান থাকেই শংকরের লেখায়। মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রাইসিটা উনি খুবই ভালো উঠে আসে লেখকের কলমে। অনেকের মতোই চৌরঙ্গী প্রদীপবাবুরও প্রিয় উপন্যাসের একটা। জন অরণ্য'র ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় যখন চিত্রনাট্য দিলেন তখন তাঁর মনে ধরল। সেখানে পরিচালক যেটা বলতে চান সেটা প্রাধান্য পেয়েছে। উপন্যাসের হিসাবে হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের ট্রিয়োলজির মধ্যে ওঁর দুটো উপন্যাস আছে। সেক্ষেত্রে উপন্যাস হিসাবে আমার সীমাবদ্ধ এগিয়ে রাখতেন 'সোমনাথ'।
জন অরণ্য সিনেমায় একটা প্যাথোস আছে, শহরের ডার্কনেসটা তাঁকে টানত। সিনেমা হিসাবে অনেক ডার্ক সিনেমা এটা। সমাজের অবক্ষয়টা এই সিনেমায় অনেক বেশী প্রকাশন পেয়েছে এখানে। এই বিষয়টা একদম বিকিকিনির হাটের মধ্যে নিয়ে এসে দাঁড় করান পরিচালক। প্রোটাগনিস্টের এক বন্ধুর বোন শরীর বিক্রি করতে চায়। প্রোটাগনিস্টও কিনতে চাইলে কিনতে পারে, পে দ্যা প্রাইস। এটাই সমাজের বাস্তবতা।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম, সিনেমা শুরু হয় একটা পরীক্ষা দিয়ে, যেখানে গণটোকাটুকি হচ্ছে। দুদিন আগেও মাধ্যমিকে আবার গণটোকাটুকির কথা উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। সময়টা এতোটা এগিয়ে গিয়েও কি একই যায়গায় দাঁড়িয়ে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "দেখো আমি প্রথম 'ল' পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখেছি গণটোকাটুকি। আর তুমি যা বলছো, তা একরকম ঠিকই। আসলে, এতে কোন লাভ নেই। নিজে পড়ে না পরীক্ষা দিলে ভবিষ্যত সত্যি খুব অন্ধকার। আমার বাড়ির সামনে যেখান দিয়ে তুমি এলে, সেখানে সকাল পাঁচটা থেকে বাজার বসে। রোজ রোজ বাজারে বিক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। ভালো ভালো ছেলেরা বাজার নিয়ে বসছে। তারা খাবে কি? কোন কাজ নেই তো। কী করবে। পেট তো চালাতে হবে।"
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোর মধ্যে, বিশেষত ট্রিয়োলজির কথা ধরলে খুবই স্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা। জন অরণ্য সিনেমাতে তিনটে নারী চরিত্রকে তিনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন পরিচালক। যূথিকা, সোমনাথের প্রেমিকা আর সোমনাথের বৌদির ক্যারেক্টারটা। আবার সোমনাথের ক্ষেত্রে তখন চাকরী না পাওয়াটা আজকের দিনেও অনেকটা একই। তখনও সোমনাথকে তার বন্ধু নিয়ে গিয়েছিল স্থানীয় এমএলএ-র কাছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনও তাই।
নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত