পৌষমাসে লক্ষ্মী ব্রত

ঘরে উঠেছে নতুন ধান। নতুন গুড়ের গন্ধে মম করছে আঙিনা। নতুন ধানের শিষে ছুঁয়ে লক্ষ্মী আসেন গৃহস্থের ঘরে। মা লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতে ওঠে মানুষ। একটাই কামনা, যেন সুখ সমৃদ্ধি আসে সংসারে। অন্নের অভাব না হয়। পৌষ-মাঘ লক্ষ্মী মাস। গোটা মাস জুড়ে আরাধনা চলে লক্ষ্মীর। পৌষ মাসের শুক্লা পক্ষে ঘর-দুয়ারে আলপনায় সাজিয়ে নতুন

ধান দিয়ে লক্ষ্মীর পুজো করা হয়। চলে ব্রতকথা পাঠ।
পৌষ মাসে লক্ষ্মী পুজো নিয়ে প্রচলিত আছে কাহিনিও।
কী সেই কাহিনি?

এই দেশে এক গরিব ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী থাকত। তাদের পাঁচ ছেলেমেয়ে। খুব অভাবের সংসার। কোনও রকমে দিন কাটে। হঠাৎ ব্রাহ্মণ মারা যায়। সন্তানদের নিয়ে অশেষ দুর্গতিতে পড়ে ব্রাহ্মণী। আহার জোটে না।

সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মেয়ে। সে একদিন মাকে বলল, “মা তুমি মামাবাড়ি যাও না, মামা যদি আমাদের একটু সাহায্য করেন”।

ব্রাহ্মণীর ভাই ছিল বেশ ধনী। অনেক ভেবেচিন্তে ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে ব্রাহ্মণী গেল তার ভাইয়ের কাছে। সে সময় ভাই বাড়ি ছিল না।

অনেকদিন পর ননদকে দেখে তার ভাজ বলল, “এতদিন পর হঠাৎ কী মনে করে!” ব্রাহ্মণী তাকে নিজের অবস্থার কথা জানালো। বউ শুনে বলল, “তোমার ভাই বাড়ি নেই। আমি কিছু বলতে পারব না। তবে রোজ এসে তুমি চাল ঝেড়ে দিয়ে যেতে পার। ক্ষুদ-কুড়ো যা থাকবে, বাড়ি নিয়ে যাবে।”

ব্রাহ্মণী তাতেই রাজি হয়ে গেল। একবেলা অন্তত বাচ্চাদের খেতে দিতে পারবে। আধবেলা হলেও সই। তারপর থেকে রোজ ব্রাহ্মনী ভাইয়ের বাড়ি আসে। চাল ঝেড়ে দেয়। ক্ষুদ কুড়িয়ে বাড়ি যায়। একদিন ব্রাহ্মণীর বড় মেয়ে তাকে বলল, “মা, রোজ ভাইবোনেরা শুধু ক্ষুদ সেদ্ধ খেতে পারেনা, তুমি মামীর থেকে একটু তরকারী নিয়ে আসবে?”

 

PoushLaxmi

 

ব্রাহ্মণী ভাজকে এসে সেই কথা বলতেই, সে এক কথায় না করে দিল। ব্রাহ্মণী দুটো লাউপাতা চাইল রাঁধবে বলে। তা শুনে ভাজ বলে, “লাউ গাছের পাতা তোমার ভাই গুনে রেখেছে। ওতে হাত দেওয়া যাবে না।” ব্রাহ্মণী চলে যায়। আর কিছু বলে না। শুকনো ক্ষুদ সিদ্ধ দিয়েই তার দিন চলতে থাকে।

একদিন তার কাজ শেষ হলে সে যখন বাড়ি ফিরতে যাবে তখন, ভাজ তাকে ডেকে বলে, মাথার উকুন বেছে দিতে। এই কাজটা যদি সে করে দেয় তাহলে দুটো লাউপাতা দেবে।

ব্রাহ্মণী বলে “এমা! আজ লক্ষ্মীবার। আজ তো উকুন বাছতে নেই। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা খিদেয় ছটফট করছে...” শুনে খুব রেগে যায় ভাজ। সে বলে, “ আজ লক্ষ্মীবার হলে তবে যে আমার বাড়ি থেকে ক্ষুদ নিয়ে যাচ্ছ বড়! এতে তো ভাইয়ের অমঙ্গল হবে!”

ব্রাহ্মণীর কাছ থেকে সব ক্ষুদ কেড়ে নেয় সে। ব্রাহ্মণী কাঁদতে কাদঁতে বাড়ির পথে যায়। আর মনে মনে ভাবে আজ রাস্তায় যা পাবে তাই সিদ্ধ করে খাওয়াবে।

চলতে চলতে দেখে একটা মস্ত সাপ মরে পড়ে আছে। সে সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। মনে মনে ভাবল এই সাপ রেঁধে খেয়ে সবাই একসঙ্গে জীবন দেবে।

সাপটাকে কেটে ধুয়ে নুন দিয়ে হাঁড়িতে ফোটাতে দেয় ব্রাহ্মণী। সাপ যত ফোটে তত গোটা হাঁড়ি সঅনার ফেনায় ভরে যায়। দেখতে দেখতে হাঁড়ি উপচে সোনার ফেনায় থইথই করতে থাকে ঘর।

কিছুটা ফেনা বাটিতে নিয়ে ব্রাহ্মণী চ্যহোটে স্যাকরার কাছে। এমন সঅনার ফেনা দেখে চমকে যায় স্যাকরাও! দাম দিয়ে সে কিনে নেয় সেই সোনা।

ব্রাহ্মণী টাকা পেয়ে লক্ষ্মীর পুজো করে। প্রতিবেশিদের ডেকে প্রসাদ বিতরণে করে। তারপর ছেলেমেয়েদের কাহিয়ে নিয়ে মুখে দেয়।

এইভাবে তার সব দুঃখ দূর হয়। কোনও অভাব থাকে না আর। বাড়ি, পালকি, দাসদাসীতে ভরে ওঠে সংসার। ছেলেমেয়েরাও বড় হয়।

ব্রাহ্মণীর কথা লোকমুখে গিয়ে পৌঁছায় তার ভাইয়ের বাড়িতেও। সে তাদের নিমন্ত্রণ করে। দামী শাড়ি গহনায় সেজে মেয়ে-বৌমাদেদ্র নিয়ে গেল ভাইয়ের বাড়ি। তাদের খাতির দেখে চমকে গেল ব্রাহ্মণী। তাদের দেখে ভাজের খুব হিংসে হল। তাদের সোনার থালায় রুপোর বাটিতে খেতে দিল। সব গহনা খুলে রেখে ব্রাহ্মণী বৌমাদের নিয়ে খেতে বসল। তারা মন মনে বলতে লাগল,

“সোনাদানা হিরে মুক্তা ধন্য মান্য গণ্য
যাদের কল্যাণে আজ মোদের নেমতন্ন”

ভাজ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল ওরা কী বলছে। ননদ বলল, “যখন আমাদের দুঃখ ছিল তখন ক্ষুদ লাউয়ের পাতাও কেউ দিতে পারেনি, এখন অবস্থা ফিরেছে তাই সোনার থালা আর রূপোর বাটিতে আমাদের খেতে দিচ্ছে।”

ব্রাহ্মনীর ভাজ আর ভাই তখন লজ্জায় লাল। তারা দিদির হাত ধরে ক্ষমা চাইল। ব্রাহ্মণী মনে খেদ না রেখে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

অনেকদিন সুখে ঘরকন্না করার পর ব্রাহ্মণী স্বর্গযাত্রা করল। তার আগে বৌমা আর মেয়েদের পৌষমাসে লক্ষ্মীর ব্রত শিখিয়ে দিল। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল পৌষ মাসের এই ব্রতকথা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...