মিল-অমিলের আখ্যানে বলরাম ও মহাবীর

শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম আর জৈন ধর্মের মহান তীর্থংকর মহাবীরের জন্ম থেকে মৃত্যুগাথা অব্দি আশ্চর্য সব সমাপতন রয়েছে। একজন শেষনাগের অবতার, অন্যজন শেষ তীর্থংকর। জন্মসূত্রে দু'জনেই ক্ষত্রিয়। বলরাম তাঁর বল ও বীরত্বের জন্য 'বলদেব' নামেও পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে বর্ধমান মহাবীরের জীবনেও সাহস আর বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।

ছোটবেলার কথা। একদিন যমুনাতীরে বলরাম, কৃষ্ণ ও গোপবালকেরা দড়ি টানাটানির খেলা খেলছিলেন। বলরামের বিপক্ষ দলে ছিলেন কৃষ্ণ। এ-খেলার নিয়ম, যে-দল হারবে তারা বিজয়ী দলের নেতাকে কাঁধে চড়িয়ে খানিকটা পথ ঘুরিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। জয়ী দলের এতেই আনন্দ। সেদিন খেলায় জিতেছিল বলরামের দল। তাই কৃষ্ণের দলের ছেলেরা একে একে বলরামকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে আসতে লাগল।

এইসময় কংসের আদেশে কৃষ্ণকে হত্যা করতে সেখানে হাজির হল প্রলম্ব-নামের এক অসুর। কিন্তু, সে কৃষ্ণকে চিনত না। শুধু জানত, কৃষ্ণ হচ্ছেন গোকুলের বালকদের নেতা। সুতরাং, নেতাগোছের ছেলেকে পেলেই তাকে হত্যা করতে হবে। তাই বলরামকে নেতা হয়ে ছেলেদের কাঁধে চড়তে দেখে তাকেই সে ভেবে বসল কৃষ্ণ। এবং তক্ষুনি গোপবালকের রূপ ধরে ছেলেদের দলে মিশে গেল। ভেবেছিল, আর সকলের মতো সেও বলরামকে কাঁধে নেবে, তারপর কাঁধ থেকে ফেলে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবে।

কিন্তু, বলরাম কাঁধে উঠে তার হাবভাব দেখেই বুঝলেন, এ গোপবালক নয়, নিশ্চয়ই কোন অসুর দুরভিসন্ধি নিয়ে এখানে এসেছে। তখনই তাকে জব্দ করতে তিনি শরীরের ভার এমন বাড়িয়ে দিলেন যে, প্রলম্বের মনে হল তার কাঁধে চেপে বসেছে কোন বিশাল এক পর্বত! সেই বিপুল ভার সইতে না-পেরে সে যখন বলরামকে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল, তখন বলরাম তার কাঁধ থেকে নেমে একহাতে তাকে তুলে আছাড় দিয়ে মেরে ফেললেন।

মহাবীরও ছোটবেলায় ছেলেদের সঙ্গে একদিন আমলকি খেলা খেলবেন বলে খেলার মাঠে এসেছিলেন। মাঠের মাঝে ছিল বিরাট বিশাল একটি বটগাছ। আমলকি খেলার নিয়ম হল, যে গাছটিতে আগে উঠে আগে নেমে আসতে পারবে, সেই হয় জয়ী। খেলার শুরুতেই সকলে একসঙ্গে ছুটল বটগাছটির দিকে। কিন্তু, গাছটার কাছে গিয়েই সকলে হঠাত গেল থমকে।

তারপর ভয়ে এক ছুটে পিছিয়ে এল তারা। কারণ, সেই বিরাট গাছটার গুঁড়ি পাকে পাকে জড়িয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ানক বিষধর এক সাপ। যেমন বিশাল তার শরীর, তেমনি ভয়াল তার গর্জন। সাপটাকে দেখে ছেলেদের হাড় হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল! কিন্তু, মহাবীর তখনও স্থির। তিনি বীরের মতো নির্ভয়ে সাপটার কাছে গিয়ে তার লেজ ধরে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন যোজনখানেক দূরে। তারপর তরতর করে উঠে গেলেন গাছে এবং নেমেও এলেন সবার আগে।

সাপটি আসলে স্বর্গের এক দেবতা। তিনি সাপ-রূপে এসেছিলেন মহাবীরের বীরত্বের পরীক্ষা নিতে। কিন্তু, মহাবীর তাঁকে অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পর তাঁর খুব রাগ হল। তখন রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহাবীরকেও আছাড় মেরে শোধ নিতে চাইলেন।

তারপর একটি ছেলের রূপ ধরে খেলার মাঠ থেকে মহাবীরকে হঠাৎ কাঁধে তুলে নিয়ে বাতাসের বেগে দিলেন দৌড়। তাঁর কাঁধে চড়ে মহাবীর ভয় তো পেলেনই না, বরং দেহের ভার বাড়িয়ে দিলেন সহস্রগুণ। আর তাতেই সেই দেবতার প্রান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। সেইসঙ্গে তাঁর অহংও চূর্ণ হল। তখন সেই দেবতা স্বরূপে এলেন। তারপর মহাবীরের বীরত্বের কাছে নতিস্বীকার করে প্রণতি জানিয়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন।

চৈত্র মাসের গভীর রাত। আকাশে তখন শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ। ক্ষত্রিয়-কুণ্ডপুরের রাজা সিদ্ধার্থর চোখে তখনো ঘুম নেই। প্রবল উৎকন্ঠায় অন্তঃপুরে তিনি প্রহর গুণছেন। কখনও অস্থির পায়চারি করছেন, কখনও বা গবাক্ষ দিয়ে চাঁদের গতিপথের দিকে তাকিয়ে দেখছেন রাত কত হল। খানিক আগেই রানি ত্রিশলার প্রসব বেদনা উঠেছে, সেজন্যই তাঁর এত উৎকণ্ঠা, এত অস্থিরতা।

রানি ত্রিশলা গর্ভ যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন বটে, তবু তারই মাঝে সেই গর্ভাধানের দিনটির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। সেদিন রাতে একের পর এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন ত্রিশলা। স্বপ্নে দেখেছিলেন হস্তী, বৃষ, সিংহ, লক্ষ্মী, পুষ্পমালা, চন্দ্র, সূর্য, ধ্বজ, কলশ, সরোবর, দেববিমান, সমুদ্র, রতন ও নির্ধূম অগ্নি প্রভৃতি। রাজজ্যোতিষী স্বপ্নফল বিচার করে বলেছিলেন, এই সব স্বপ্নে দেখার অর্থ, রানির গর্ভে জন্ম নিতে চলেছেন এমন এক পুরুষ, যিনি হয় রাজচক্রবর্তী হবেন, নয় হবেন মহান তীর্থঙ্কর। সেই থেকে শুরু হয়েছিল প্রতীক্ষার। কিন্তু, এই জন্মকাহিনি এতটা সহজ নয়।

ত্রিশলার কিছুদিন আগে পাশের গ্রাম ব্রাহ্মণ-কুন্ডপুরের ব্রাহ্মণ ঋষভদেবের পত্নী দেবনন্দাও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বামীস্ত্রী দুজনেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, তাঁদের ঘরেই আবির্ভাব হবে যুগপুরুষ-এর। কিন্তু, ক'দিন যেতে-না-যেতেই এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলেন দেবনন্দা। দেখলেন, তাঁর গর্ভের সন্তান নিয়ে চলে গেলেন রানি ত্রিশলা!

আসল ঘটনাটা হল, প্রথমবার মহাবীর জন্ম নিয়েছিলেন জৈনদের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেবের পৌত্র মারীচ হয়ে। কিন্তু, মারীচ যখন এক দেবদূতের মুখে শুনেছিলেন যে, তিনিই পরজন্মে উত্তমকুলে তীর্থঙ্কর হয়ে জন্ম নেবেন, তখন তাঁর মনে অহং এসেছিল। তাই মহাবীর হয়ে জন্মানোর আগে অহংজাত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে প্রথমে অখ্যাতকুলের ব্রাহ্মণী দেবনন্দার গর্ভে পাঠালেন। কিন্তু, ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নিলে তীর্থঙ্কর হওয়া যায় না, সেজন্য ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম নিতেই হয়।

এদিকে দেবনন্দা আর ত্রিশলা দুজনেই গর্ভবতী। একজনের গর্ভে তখন মহাবীর, অন্যজনের গর্ভে আর কেউ। তাই দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের দেবী হরিণৈগমেষীকে আদেশ দিলেন, ত্রিশলার সন্তান দেবনন্দার গর্ভে স্থাপন করতে আর দেবনন্দার সন্তান ত্রিশলার গর্ভে স্থাপন করতে। দেবী তাই করলেন। সেজন্যই ব্রাহ্মনী স্বপ্নে মহাবীরকে পুত্ররূপে পেয়েও হারিয়েছিলেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত ত্রিশলার গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন মহাবীর।

ভাগবতের কৃষ্ণকাহিনিতে রাজা বসুদেবের দুই স্ত্রী—দেবকী আর রোহিণী। আকাশবানীতে রাজা কংস জেনেছিলেন যে, বসুদেব আর দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তাঁকে বধ করবেন। সেই গর্ভে এঁদের পুত্ররূপে অবতার নেবেন স্বয়ং বিষ্ণু। তাই ভয়ে বসুদেব আর দেবকী দু'জনকেই বন্দী করে রেখেছিলেন কংস এবং তাঁদের সব সন্তানকেই হত্যা করতে শুরু করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণুর এই অবতারে জ্যেষ্ঠভ্রাতা হয়ে জন্মানোর আকাঙ্ক্ষা জানিয়েছিলেন স্বয়ং শেষনাগ।

তাই দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরামরূপে আশ্রয় নিলেন তিনি। কিন্তু, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যাতে কংস তাঁকে হত্যা করতে না পারেন, সেইজন্য ভগবান বিষ্ণু শক্তিরূপিণী দেবী যোগমায়াকে অনুরোধ করলেন দেবকীর গর্ভের সন্তান রোহিণীর গর্ভে আর রোহিণীর গর্ভের সন্তান দেবকীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করতে। কারণ, সুদীর্ঘকাল ধরেই রোহিণী গর্ভে একটি সন্তান ধারণ করে রেখেছিলেন, প্রসব করেননি। সেই সন্তানকে সরিয়ে দেবী যোগমায়ার হস্তক্ষেপে রোহিণীর গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন বলরাম। তাই বলা যায়, বলরাম যেমন দুই মায়ের গর্ভস্নেহ পেয়েছিলেন, তেমনি মহাবীরও দুই মায়ের গর্ভবাস করেছেন। দু'জনের কাহিনিতেই গর্ভ স্থানান্তরের কাজটি করেছিলেন দুই দেবী।

শ্রমণ হয়ে প্রব্রজ্যা নিয়ে মহাবীর পুরোপুরি বৈরাগ্য আর অহিংসার পথে হেঁটেছেন। কিন্তু, বলরামের ক্রোধ ছিল মারাত্মক। অবশ্য তা প্রশমিতও হত খুব তাড়াতাড়ি। আত্মরক্ষা ও ক্ষত্রিয়ধর্ম রক্ষার জন্য ‘হল’-রূপ আয়ুধ ধারণ করে তিনি 'হলায়ুধ' নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু, অস্ত্রধারণ করেও তিনি কুলবিধ্বংসী কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে অংশ নেননি। শান্তির বাণী ও আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিস্থাপনায় তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। প্রায় শ্রমণের মতোই তীর্থ পর্যটনে তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে।

কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চদশী তিথিতে যোগসমাধিতে লীন হয়ে বর্ধমান মহাবীর ইহজীবন ত্যাগ করেছিলেন। দ্বাপরের শেষে লোহার মুষল বাগিয়ে যদুবংশ যখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে শেষ হচ্ছে, তখন বলরামও একটি গাছের ওপর উঠে যোগসমাধিতে লীন হয়ে তনু ত্যাগ করেছিলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...