“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে – চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয় – এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে – চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয় – যাবো – কিন্তু এখনি যাবো না – তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো – একাকী যাবো না অসময়ে ।”
অনঘ কবি তিনি, কথা রাখার দায় তার নেই, ছিল না। সেইমত একাকী জানিয়েছেন বিদায়। কেবলমাত্র দূরদর্শীতায় গেঁথে গেছেন মৃত্যুপূর্ববর্তী কিছু প্রকট বিদায়সম্ভাষণ। রচক-কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ২৩শে মার্চ, ২৪ বছর হল, গেছেন যে পথে যেতে হয় অনিবার্যভাবে।
ভাবতে পারিনা কখনও কবির মৃত্যু সম্বন্ধে, বুঝে উঠতে পারবো না এ অবকাশের প্রয়োজনীয়তা। শুধু ভাবতে পারি তিনি আমলকী বাদাড়ের নিভৃতে অস্পষ্ট-বেসামাল-অনর্গল বলছেন, “ পথে যেতে কষ্ট হয়, পথের একপাশে বসে থাকি।/ গভীর গাছের নিচে বসে থাকি যেন শুকনো পাতা – / পাতার মতন থাকি, কষ্ট পাই, বাতাসের হাতে, / উড়ে যেতে পারি ব’লে ভয় পাই, পুড়ে যেতে পারি। / পথে যেতে কষ্ট হয়, তাই একপাশে বসে থাকি। ”
একবার বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যু স্মৃতিতে তাঁর লেখা ‘শেষ’-এ তিনি বলেছিলেন, “আমি শোক মিছিলে যাই না…পালিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে কোনো সংশ্রব না থাকুক- এই চাই… বুদ্ধদেব নেই- আকাশবানী থেকে প্রচারিত সংবাদটুকু শুনে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়েছি- তখন সকাল। জানালা-দরজা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়েছি। শুয়েই ছিলাম, আমার বন্ধুরা এসে জোর করে নিয়ে গেল……সেখানে পৌঁছেই সব মানুষের অবনত মাথা আর ফুলগন্ধ আমাকে ভীষণ জব্দ করে। তখনো তার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখিনি। সেখানে স্তব্ধতা আর মানুষের অসহনীয় ভীড়। কারুকে কাঁদতে দেখলেই আমার চোখে জল এসে পড়ে। বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগে। যেখানে সবার চোখে জল, মুখ বিষাদ-থমথমে, আমি সেখানে দাঁড়াতে পারি না। কেন এলুম? নিজেকে ভর্ৎসনা করি, মনে মনে। অসহ্য এক বেদনার নীল রং আমার মুখে চোখে জুড়ে বসে।” কবি-মৃত্যুতে তাঁর শোণিতশিরা দিয়ে বয়ে যেত প্রচন্ড আতশী। এ দহন তিনি তাঁর অনু-জীবনে ‘বেয়াক্কেলে’ মাদকাসক্তি দ্বারা মকুব করতে পারেননি, এ আমার নিবিড় অনুধাবন। এই এই সময়ে উন্মাদী মাতাল কবি নিদারুন ভাবাবেগে লাথি কষাতে কষাতে প্রমত্ত আবৃত্তি করতেন, “মৃত মুখ, তাকে আমি কুয়োর জলের মতো স্তব্ধ মনে করি/ পাতালের তাপ যদি কিছু থাকে, তাকেও স্থিরতা কঠিন আঙুল তুলে ঘুম পাড়ায়, ধ্যানমগ্ন করে/ আমি ভয় পাই, আমি মুখ ঢাকি, বাস্তবে তবুও কবির গণনা বলে,
ও মুখ-পাষাণই প্রিয়তম/ রূঢ় সুষমার পংক্তি, ওই শব্দ, স্মৃতির জননী…/কিন্তু সে কবিও যান হাতে-গড়া শস্যক্ষেত্র ছেড়ে একদিন/ পাকা ও প্রসন্ন ফল ঝরে পড়ে তপোক্লিষ্ট ভুঁয়ে/ শীতের বাদাম করে ওড়াউড়ি, ময়দানের ঘাস গভীর আগুনে যায় উড়ে-পুড়ে…দেখে মনে হয়,/ কলকাতা কবির মৃত্যু সমর্থন করে…।”
তিনি জন্মেছিলেন দক্ষিন চব্বিশ পরগনার তৎকালীন গন্ডগ্রাম বহড়ুতে, ডাকনাম বড়ু। বাবা বামানাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মা কমলা দেবী। বাবা মারা গেলেন যখন তখন তাঁর নামমাত্র বয়েস, সবে চার। তারপরই মা আর ছোটভাই মামার সংসারে…কলকাতায়। শুধু তিনি একা রয়ে গেলেন বহড়ুতে তাঁর দাদামশাইয়ের কাছে। ছোট বেলায় কচিৎ দাদুর হাত ধরে কলকাতায় গেছেন হয়ত, সে অভিজ্ঞতা বিষয়ে তিনি বলছেন “কলকাতার রাস্তা যেন জলপ্রপাত, তার গা থেকে গাড়িঘোড়া সব হুড়মুড় করে ধারাবাহিক গড়িয়ে পড়ছে। নীচে গভীর খাদ। হাঁ করে আছে কলকাতা শহর। তার খিদে সাংঘাতিক।”
১৯৪৮ সাল নাগাদ তিনি এলেন কলকাতায়। বাগবাজারের স্থানীয় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে ভর্তি হন। স্কুলটি ছিল মামার বাড়ির অনেক কাছে। তাঁর লেখাপড়ায় সমুহ টান দেখে তাঁর মামা ভাবেন ভাগ্নে বুঝি খুব বড়ো মাতব্বর হবেন, বাড়ির নাম রাখবে। তখনই তিনি বলছেন, “বাড়ি কোথায়? বাড়ির আবার নাম কি? রাজনৈতিক দলের সাথে ঐ বয়সেই জড়িয়ে গেলাম।একা থাকার অপরূপ কষ্ট থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্যেই মনে হয় আজ। কিছু বুঝি না, কিছু জানি না। স্বর্গের একটা গোলকধাম-মার্কা ছবি আমাদের, বালকদের স্বপ্নের দোরগোড়ায় লটকে দেওয়া হল।” যতদূর জানা যায় স্কুলেরই একজন শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি প্রথম মার্ক্সবাদ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং উষ্মা প্রকাশ করেন।
তারপর স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি, তা শেষ না করেই আবার বাংলা নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে। শোনা যায় দারিদ্রের কারনে পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে ছাড়তে হয় প্রেসিডেন্সি। তাঁকে উল্টোডাঙ্গার একটি বস্তিতে মা ও ভাইকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। তবে প্রেসিতে পড়ার সময়ই মোটের ওপর তৈরী হয় তাঁর সাহিত্যসোপান। তখন উন্মাদ-উদ্বেল আনকোরা একদল যুবক কবিতা ওড়ায় উন্মুক্ত হাওয়ায়। কিছু উড়ে উড়ে বসে গাছের তলায়, শশ্মান ঘাটে, পার্কে-ময়দানে, কিছু টালমাটাল হেঁটে ফিরে যায় বাড়ি।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’, যা তাঁর শৈশবের কাহিনী, যে উপন্যাসে তিনি নিজের নাম দিয়েছিলেন নিরুপম; পরে নিজের জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে আরও যে আখ্যান তিনি লিখেছিলেন, প্রতিটি উপন্যাসেই তিনি নিরুপম। ‘কিন্নর কিন্নরী’, যা তাঁর প্রথম প্রেম, কবি হয়ে ওঠা এবং কবি বন্ধুদের নিয়ে, এই আখ্যানে তিনি নিরুপম নামটা বাদ দিয়ে নিজেকে বললেন পার্থ। উপন্যাসটিতে সুনীল, সন্দীপন, দীপক, উৎপল আছেন এবং আছেন সমীর রায়চৌধুরী আর আছে চাইবাসা, লুপুংগুটু ঝর্না, রোরো নদী, হেসাডির অরণ্য, মধুটোলা, সেনটোলা। কবির প্রথম কবিতা ‘যম’ ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়। আর কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখী সংখ্যায়। কৃত্তিবাসের সাথে অন্তরঙ্গ যুক্ত ছিলেন তিনি। নিজেই বলেছেন, “আমরা সবসময়ই আমরা। এক পরিবারের লোক। সে পরিবারের পদবী, ‘কৃত্তিবাস’।” প্রায় পঁয়তাল্লিশটি অসাধারন বইয়ের জন্ম দিয়েছেন তিনি, যাতে আছে আড়াই হাজারেরও বেশি কবিতা। তিনি নিজের কবিতাকে বলতেন- পদ্য। এই প্রসঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন-‘ এ কালের কবিতা-নামধেয় লেখাগুলোকে ঠেস দেবার জন্যই বোধহয়, শক্তি নিজের কবিতাকে বলত ‘পদ্য’…পদ্য ছিল তার কাছে শুচিশুদ্ধতার প্রতীক এক নামাবলী মাত্র…না শব্দ না ছন্দ-কোনো কিছু দিয়েই তার কবিতা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নয়। তার জাফরি দিয়ে সমানে হাওয়া খেলে।’ শক্তি বলেন –‘শুদ্ধসীমা থেকে যাত্রা কবিতার সর্বাঙ্গে।’ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম, হে নৈশব্দ’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। জলোচ্ছ্বাসের মতোই ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছেন, ভেঙেছেন, গড়েছেন, দিক বদল করেছেন, ভাসিয়ে দিয়েছেন যিনি, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্র ঠিকানা।
কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর ‘এক উন্মত্ত দরবেশের কথা’য় লিখেছেন, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিদিনের বেঁচে-থাকাকে একটি উৎসবে পরিণত করেছিলেন। এই শহর টের পেত তাঁর বেঁচে থাকার কোলাহল। ‘আমার বন্ধু শক্তি’তে সমীর সেনগুপ্তর স্বগতোক্তি-“ধরে নিয়েছিলাম শক্তি থাকবে চিরকাল, মানুষকে চিরদিন ভালোবাসবে, পশুপাখিকে ভালোবাসবে, গাছপালাকে ভালোবাসবে। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, ওর বিরোধ সব শুধু ওর নিজের সঙ্গে, ও পালাতে চায় শুধুমাত্র নিজের কাছ থেকে—নিজে ছাড়া আর সকলেই ওর বন্ধু। সমস্ত মানুষের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা, অথচ ভিতরে ভিতরে এত সুদূর, এমন মানুষ আর দেখব না। সামাজিকতার সম্পর্ক পার হয়ে, বাক্ ও অর্থের হানাহানি শেষ হবার পর একটা জায়গায় শক্তির মতো নিঃসঙ্গ কেউ ছিল না, অমন অনুপস্থিত মানুষ আর কখনো দেখিনি।’”
“ সমস্ত নক্ষত্র আজ নক্ষত্রের ভিতরের ক্রোধ
বোঝাতে না পেরে যেন আরও দূরে চলে যেতে থাকে
অভিমানই এরকম অঘটন ঘটাতে সক্ষম-
এই ভেবে, মানুষেরও বুক অভিমানে ভরে যায়
মানুষ নক্ষত্র নয়, নক্ষত্রের মতো দূরে নয়
মানুষের মধ্যে তবু নক্ষত্রপুঞ্জেরা খেলা করে।
সেরকম খেলা থেকে প্রাপনায় সমস্ত বোধের
জন্ম হয়, মৃত্যু হয় –মানুষেরই মধ্যে যেতে থাকে
সমস্ত নক্ষত্র আজ নক্ষত্রের ভিতরের ক্রোধ
বোঝাতে না পেরে যেন আরও দূরে চলে যেতে থাকে…।”
এভাবেই তাঁর নিজের যাপনের প্রতিবিম্ব প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে তাঁর হস্তাক্ষরে। আবার আমলকী বাদাড়ের নিভৃতে অস্পষ্ট-বেসামাল-অনর্গল উচ্চারন … মনে মনে বহু দূর চলে গেছি… মনে মনে বহু দূর চলে গেছি… !