যারা জীবনানন্দকে শান্তি দিয়েছিল

জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যে বনলতা সেন ছাড়া তাঁর আরও বেশ কয়েকজন প্রেমিকা আছে। তারা হল সবিতা, সুদর্শনা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, শ্যামলী, অরুণিমা আর শঙ্খমালা। তবে গাঁইগোত্র নিয়ে হাজির হয়েছে কেবলমাত্র বনলতা সেন আর অরুণিমা সান্যাল। 



শ্যামলী বড় আটপৌরে। তার মুখে আটপৌরে চাওয়া-পাওয়ার মায়া আছে। সে-মায়ায় ভুলে তাকে খুশি করতে সোনার সন্ধানে নেমে পড়ে যুবক পুরুষ। সমুদ্র দাপায়। ‘সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে,/মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল/টের পেয়ে’ অকূলে পাড়ি দেয়। হারিয়ে যায়। সে-চাওয়ায় পুরুষের মতো সময়ও অস্থির হয়। প্রবাহিত হয় রক্তনদী। শ্যামলী ভাবতে পারে না, তার ঐ-টুকু চাওয়াতে এতকিছু হয় কী করে! তাই তার মুখে সারল্য ছুঁয়ে লেগে থাকে হারিয়ে ফেলা ‘নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব’-কিছু নিয়ে অদ্ভূত এক বিষণ্ণতা।



‘হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভেতর’ জেগে ওঠে একজনেরই মুখ। সে, অরুণিমা সান্যাল। পাড়া-গাঁয়ের মেয়ে। তবুও অনেকের ভিড়ে হারিয়ে যায় না সে। তাকে নিয়ে হৃদয়ে পংক্তি বাঁধে নাগরিক মন। কিন্তু, নগরের ইঞ্জিনের শব্দ যখন বুনোহাঁসের পাখসাটে প্রতিধ্বনি হয়; সমস্ত কল্পনা গা থেকে রঙের আবরণ খুলতে খুলতে যখন হারিয়ে যায় নক্ষত্রলোকের ওপারে, একা প্রেমিক পড়ে থাকে ধুলোমাখা নাগরিক জ্যোৎস্নায়; তখন অরুণিমা সান্যালের এক টুকরো স্মৃতিই তাকে এনে দেয় বুক জুড়ানোর মন্ত্র।   

Jibanananda

শঙ্খমালা ভণিতা ভালবাসে না। সে অনায়াসে ডেকে বলতে পারে, ‘তোমারে চাই’। কারণ, এতকাল ধরে যাকে সে চেয়েছে, সমস্ত অনুভব বেয়ে আকুল হয়ে তন্ন তন্ন খুঁজেছে, তাকে পেয়ে আর ভণিতা আসে না। তাই তার ভালবাসার দাবিতে সম্মতির অপেক্ষা নেই। ইতোমধ্যেই তার তৈরি হয়েছে প্রবল অধিকার বোধ। সে এক এমন মেয়ে, যে, ব্যাকুল বসন্তে যৌবনের আগুনে অনন্ত পোড়ানি নিয়েও প্রেমিকের জন্য প্রতীক্ষা করতে জানে। অপেক্ষা করতে পারে হিম দুই হাতে ঘনিষ্ঠ উত্তাপ পাবার। সে এমনই এক মেয়ে, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’



‘অমৃতসূর্যের’ সন্ধান দেয় সুদর্শনা। যুগসঞ্চিত পণ্যের বিনিময়ে তাকে হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু বিপরীতে সে পুরুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক অগ্নিবলয়ের মাঝে। বুঝিয়ে দেয়, যুগে যুগে শুধু সীতা নয়, পুরুষেরও অগ্নিশুদ্ধির প্রয়োজন। অগ্নিশুদ্ধ হয়ে পণ্যের কারবারি পুরুষ তখন শুনতে পায় দেবদারু গাছ থেকে কিন্নরকন্ঠে নতুন দিনের গান। পায় অমৃতসূর্যের দেখা। আর সুদর্শনা প্রতিদিনের সকালের রোদের মতোই পবিত্র আর নতুন থেকে যায়।



নারী হিসেবে সুরঞ্জনা, আসলে ‘পৃথিবীর বয়সিনী...এক মেয়ের মতন’। ইতিহাসের পথ পেরিয়ে মানুষের বুকে ভালবাসার আলো জ্বেলে দেবার ব্রত নিয়ে সে হেঁটে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। তার টানে পুরুষের ঘরে ফেরার সাধ হয়। একমাত্র সে সকলেরই প্রাণে জাগাতে পারে ‘ভোরের কল্লোল’।

Jibanananda1

সবিতাও প্রেমিকের সঙ্গে ইতিহাসের কঠিন পথ-পরিক্রমায় সঙ্গী। আলোর সন্ধানী সে-ও। কিন্তু, তার চুলে সমুদ্রের নুন, শরীরে ক্লান্তির ছাপ। 



সুচেতনাকে আবার এক ঝলকে বুঝে নেওয়া কঠিন। বাইরে তার কাঠিন্যের আবরণ। কিন্তু, হৃদয় এতটাই স্থির যে, কল্লোলিনী কলকাতার কোলাহলেও সে কোথাও হারিয়ে যায় না। সে প্রেমিককে ভাঙনের কালে, হতাশার কালেও পৌঁছে দেয় এক গভীর অস্তিবাদে। তাকে ‘না এলেই ভালো হত অনুভব করে;/এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি...’ এই বোধির মধ্য দিয়ে বলতে বাধ্য করে, ‘সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে–এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;’ কিংবা, ‘প্রায় তত দূর ভালো মানব–সমাজ/আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকার হাতে/গড়ে দেব, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।’



বনলতা সেন অনেকটা নির্জনতায় ঘেরা শান্ত দিঘির মতো। দিনের পর দিন প্রেমিকের জন্য সে বাইরে শান্ত অথচ ভেতরে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। প্রেমিকের প্রতি তার ‘আপনি’ সম্বোধন যদিও সেকেলে; তবু এতে এতটুকুও দূরত্ব নেই; আবেদন মাধুর্যে, আসলে তা, ‘তুমি’ই। দীর্ঘ পত্রহীন সংবাদহীন প্রবাসের পর ঘরে ফেরা প্রেমিককে সে যখন অবরুদ্ধ আবেগে ধীরে অস্ফূটে বলে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ তখনই টের পাওয়া যায় তার অব্যক্ত আকুলতা আর অপেক্ষার রঙ। ছড়িয়ে পড়ে তার নিবিড় চোখের শান্তিনীড়ের উত্তাপ। রোদ পড়ে যায়, অন্ধকার নেমে আসে, নদী চলে যায়, শুধু অপেক্ষা করে বনলতা সেন। সে রোদের মায়া নয়, অন্ধকারের আবিলতা নয়, সে উপেক্ষমান নদীও নয়, সে শাশ্বত নারী। 



মানুষ মননে স্বভাবত বহুগামী। কবির কবিতার নারীরাও তাই একক সত্তায় নির্দিষ্ট নয়, তারা ভিন্ন নামে ভিন্ন ব্যক্তিত্বে বহুর প্রতিনিধি। তবুও তারা এক জায়গায় এক, সেখানে তারা শুশ্রূষাদায়িনী। তাই বনলতা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা - এইসব কাব্যনারীদের শাশ্বতপ্রেমিক জীবনানন্দ দাশের মতো স্বভাবলাজুক কবিও কাব্যবাসরে একটু প্রগলভ হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন:

‘নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো

এখনো নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।’

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...