দেশপ্রিয় পার্কের এক বেঞ্চে বসে কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ একদিন জীবনানন্দের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক বড়বাড়ির পরিচারিকার কোল থেকে একটি শিশুকে পড়ে যেতে দেখলেন বিমলচন্দ্র, দেখলেন শিশুটিকে সুতীব্র স্বরে কেঁদে উঠতেও। স্বভাবতই তিনি বিচলিত হলেন। কিন্তু, সেই কান্না শুনে জীবনানন্দ তাঁর মতো মোটেই বিচলিত হলেন না, ফিরেও তাকালেন না। বরং বিরক্ত হয়ে বললেন, 'অসহ্য, শহরে দুদণ্ড শান্তি নেই!' অথচ, এই বিরক্ত মানুষটাই বাড়িতে ফিরে যদি দেখতেন স্ত্রী লাবণ্য ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করছেন, তখন ছেলেমেয়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীকেই হয়তো এক প্রস্থ বকে দিতেন! ঘরে-বাইরে এমনই বৈপরীত্য ছিল জীবনানন্দের স্বভাবে।
কাজেই, জীবনানন্দকে 'নির্জনতার কবি' আখ্যা দেওয়া হলেও, তাঁকে 'অসামাজিক' বলে প্রতিপন্ন করা গেলেও, পারিবারিক মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন একেবারেই উল্টো। ছেলেমেয়ের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মতো মিশতেন: হয়তো ছেলে রসগোল্লা খাচ্ছে, জীবনানন্দও রসগোল্লা খেতে দারুণ ভালোবাসতেন; ফলে, তক্ষুনি ছেলের কাছে বন্ধুর মতোই গিয়ে আব্দার ধরলেন, 'আধখানা দে না রে!' বাবার সঙ্গে বন্ধুতা থেকেই ছেলেমেয়েরা পড়ার অবসরে নিয়মিত আড্ডা বসাত কবিতাপাঠের। বাবার অনেক কবিতারই প্রথম শ্রোতা কিন্তু তারা।
মুখচোরা কবির দাম্পত্যজীবনের অনেক অনেক মধুর ছবি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় স্ত্রীর সঙ্গে অনেক খুনসুটির মুহূর্ত। গেঞ্জি গায়ে চেয়ার-টেবিলে কবিতা লিখতে বসা ছিল জীবনানন্দের স্বভাব। তেমনই হয়তো একদিন বসেছেন। আর ঠিক তখনই স্ত্রী লাবণ্যর দরকার পড়ল সেই গেঞ্জিটাই কাচবার। কবি কিছুতেই গেঞ্জি খুলবেন না, লাবণ্যও জেদে খুলিয়ে ছাড়বেন। শুরু হল দু'জনের মিষ্টি খুনসুটি। শেষ পর্যন্ত লাবণ্য যখন কাঁচি এনে গেঞ্জি কেটে ফেলার হুমকি দিলেন, তখন কবি হয়তো হার মানলেন। খুনসুটির হাসি হাসতে হাসতে গেঞ্জিখানা খুলে দিয়ে আবার ডুবে গেলেন কবিতার নিজস্ব ভুবনে। এমন কত বার ঘটেছে...
লাবণ্য ও জীবনানন্দের বিয়ে হয়েছিল ব্রাহ্মমতে। অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে। বিয়েতে বরযাত্রী ছিলেন মাত্র দু'জন। কবি বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্ত। বিয়ের সময় কবির বয়স আঠাশ কিংবা উনত্রিশ। তিনি তখন দিল্লির একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক; আর লাবণ্য সবে ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রী। বিয়ের সম্বন্ধটাও হয়েছিল নিতান্তই সাদামাটাভাবে, তবে দেখাশুনা করে।
লাবণ্য মানুষ হয়েছিলেন জেঠার স্নেহে। ছোটবেলাতেই বাবামাকে হারিয়েছিলেন তো, তাই। পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, থাকতেন হোস্টেলে। সেখান থেকে তাঁকে ডাকিয়ে আনা হল এক বর্ষার দুপুরে। হঠাৎ তলব পেয়ে নকশাপাড় শাড়ি পরে এক মাঠ কাদা ভেঙে প্রায় হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন জেঠার বাড়িতে। ভেবেছিলেন কী-না-কী ব্যাপার, এসে দেখলেন কে-না-কে এক অতিথি এসেছেন, তাঁর জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে যেতে হবে! বেশ, হাতপা ধুয়ে সেই অতিথির জন্য নিয়ে গেলেন চা-বিস্কুট।
অতিথির সঙ্গে জেঠা আলাপ করিয়ে দিলেন। টুকটাক দুটো কথা হল। ব্যস, হয়ে গেল জীবনানন্দের কনে দেখা। জেঠাকে আলাদা করে জানিয়ে দিলেন, কনে তাঁর পছন্দ। চা-বিস্কুটের আব্দার এবং আলাপ দুইয়ের ভেতরে যে কনে দেখানোর চাতুরী আছে, এটা লাবণ্য ভাবতে পারেননি। ব্রাহ্মবাড়িতে মেয়েরা অন্তঃপুরিকা নয়, তাই আলাপ করানোর মধ্যেও অন্য অভিসন্ধি তিনি খুঁজে পাননি। তাই জেঠা যখন জীবনানন্দের পছন্দের কথা বললেন, তখন লাবণ্য স্বাভাবিকভাবেই আকাশ থেকে পড়লেন। বিয়ের জন্য খানিক গাঁইগুঁই করলেন, আবার পাত্রকে যে মনে ধরেছে, এও স্বীকার করে বসলেন। ফলে, বিয়েটা আটকাল না, বেশ আনন্দের মধ্য দিয়েই হয়ে গেল।
বিয়েতে গাঁইগুঁই করার একটাই কারণ, লাবণ্য ইতিমধ্যেই পরাধীন দেশের সশস্ত্র সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধার দলে নাম লিখিয়েছেন। বিয়ের পরও তাঁর সঙ্গে তলে তলে দলের যোগাযোগ রয়ে গেল। বিয়ের সময় জেঠাকে জীবনানন্দ কথা দিয়েছিলেন, লাবণ্যকে বিয়ের পরও পড়াবেন। বাড়ির সঙ্গে লড়াই করেও বাবার অনুমতি আদায় করে জীবনানন্দ সে-কথা কিন্তু রাখলেন। এই মুহূর্তে স্বামী ও শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দকে সবসময় পাশে পেলেন লাবণ্য। জীবনানন্দের কাছে লেখা ছিল অন্তঃপুরের প্রেয়সীর মতো, তাকে সবার সামনে বের করতেন না, সযত্নে লুকিয়ে রাখতেন বাক্সের মধ্যে। নিজস্ব লেখা সম্পর্কে জীবনানন্দের স্পর্শকাতরতা ও ভালোবাসা আজ মিথ। কিন্তু, লাবণ্যর প্রতি তাঁর ভালোবাসা সেই মিথের অনেক অনেক ওপরে, তারও পরিচয় মেলে একটি ঘটনায়:
গোপনসূত্রে খবর পেয়ে একদিন পুলিশ তাঁদের বরিশালের বাড়িতে হানা দিল। বাড়িতে আপত্তিকর কাগজপত্র থাকা এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে লাবণ্যর যোগাযোগের অভিযোগে। লাবণ্যর তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়া চলছে। খবর পেয়ে ক্লাস ছেড়ে তিনি ছুটতে ছুটতে যখন এসে পৌঁছলেন, তখন পুলিশি তল্লাশিতে বাড়ি একেবারে বিপর্যস্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে জীবনানন্দের ছেঁড়াখোঁড়া পাণ্ডুলিপি। আর তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন চিন্তাক্লিষ্ট জীবনানন্দ। পাণ্ডুলিপির দিকে তাঁর কোন ভ্রূক্ষেপই নেই, চোখেমুখে একমাত্র চিন্তা শুধু লাবণ্যর জন্য। লাবণ্যকে পুলিশ ধরলে কী হবে, সেই চিন্তা!
খানাতল্লাশি চলছিল। তাতে পুলিশ আবিষ্কার করে ফেলল আয়ারল্যান্ডের একখানা বৈপ্লবিক ইতিহাস। তখন আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস ইংরেজের কাছে নিষিদ্ধ একটি বিষয়। বইটা দেখেই তো লাবণ্য ও জীবনানন্দের আক্কেলগুড়ুম! এবার কী হবে! পুলিশ চেপে ধরল লাবণ্যকে। তবে লাবণ্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েও হঠাৎ বলে বসলেন যে, ওটা নাকি তাঁর ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাসপাঠ্য ইতিহাস বই!
ব্যস, এতেই কাজ হল। ভাগ্যিস, পুলিশটার বিদ্যের দৌড় ইন্টারমিডিয়েট অব্দি ছিল না এবং কী ভাগ্যিস সে লাবণ্যর কথাটাকেই বিশ্বাস করে বসল। তারা চলে গেল। তখন হাঁফ ছাড়লেন সকলে। আর জীবনানন্দ? যে মানুষটার কাছে নিজের লেখার পাণ্ডুলিপি হৃৎপিণ্ডের মতো, সেই তিনি পুলিশের ছিন্নভিন্ন করে যাওয়া পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে একটাও কথা বললেন না। শুধু পাণ্ডুলিপিগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে লাবণ্যর দিকে চেয়ে বললেন, 'আচ্ছা কী হত বলতো, যদি ওরা খোঁজ নিত বইটা সত্যিই পাঠ্য কিনা!' জীবনানন্দের চোখে তখনও প্রিয়তমার জন্য ভয় আর অফুরন্ত ভালোবাসা।
বিয়ের সময় জেঠাকে কথা দিয়েছিলেন জীবনানন্দ মা-বাপ মরা লাবণ্যের মনে কোনদিন কোন কষ্ট দেবেন না। কথা রেখেছিলেন তিনি। প্রাত্যহিক আচারে-ব্যবহারে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেছিলেন। শুধু অকাল মৃত্যু তাঁকে শেষ অব্দি কথা রাখতে দিল না। দিলেন অশেষ বিচ্ছেদযাতনা। অবশ্য এতে তাঁর তো কোন হাত ছিল না। তবে, কথা প্রসঙ্গে বারে বারেই বলতেন বৈধব্যের কৃচ্ছ্র না-করতে। সে-সব তাঁর ভালো লাগে না। বাংলার শ্যামল রূপের মতোই, সিমন্তিনী স্নিগ্ধরূপই তিনি আজীবন দেখতে চেয়েছিলেন নারীর মধ্যে, প্রিয়তমা পত্নীর মধ্যেও।
রবীন্দ্রনাথের 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে' গানটা ছিল জীবনানন্দের অসম্ভব প্রিয়। গানটার গায়কীতে একটা বিষাদের সুর মিললেও, এ-গান আদ্যন্ত আসলে আশাবাদী জীবনের কথাই বলে। ঠিক যেন আমাদের জীবনানন্দের মতো। যাঁর কবিতায় এত মৃত্যুচেতনা, যিনি কবিতায় আকাঙ্ক্ষা করতেন জনহীন নির্জনতা, যাঁকে কাব্য-রসিকেরা 'নির্জনতার কবি' উপাধি দিয়ে বসলেন, সেই মানুষটিই যখন ট্রাম দুর্ঘটনায় নিদারুণ আহত হয়েও ক্ষনিকের সম্বিত পেয়ে অস্ফুটে বলে ওঠেন - 'আমি কি বাড়ি যেতে পারি?', সর্বাঙ্গে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে 'আমি বাঁচবো তো? বুবু, আমায় বাঁচিয়ে দে ভাই। ডাক্তারবাবু - আমাকে আপনারা বাঁচিয়ে দিন ডাক্তারবাবু!'- বলে করুণ আর্তনাদ করে ওঠেন; তখন 'নির্জনতার' তকমা পেরিয়ে জীবনানন্দের স্ত্রীসন্তানের সাহচর্যকামী-প্রবল গৃহী-জীবনসংরাগী প্রতিমূর্তিটি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে প্রতিমূর্তি আমাদের মিথমথিত চেনা জীবনানন্দের একেবারে বিপ্রতীপ।
তথ্যঋণ: কবিপত্নী লাবণ্য দাশের লেখা নানান স্মৃতি আলেখ্য।