বাঈনাচ ও বাবুদের দুগ্গাপুজো

কলকেতার বাবুদের মোয়াই বেমক্কা মনটি খারাপ। কেন কেন কেন? আরে বাওয়া, দুগ্গাপুজো হবে, সে ঠিকাচে; কিন্তু এদিকে বটখেরার মৌতাতেই যে শনি লেগেচে, পড়েচে মহামায়ার মার! তেনাদের মায়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো আর মহরম পড়েচে এক্কেরে! তা পড়েচে তো পড়েচে, তাতে হয়েচেটা কী? মহরম হবে মহরমের মতন, দুগ্গাপুজো হবে দুগ্গাপুজোর মতন; সেখেনে বাবুদের মনখারাপেরই বা কী, মৌতাতে মারটাই বা কোথায়!

আরে মোয়াই, সালটা যে ১৮২০, সেটি ভুললে চলবে? ভুললে চলবে, কলকেতার বাও-বাতাসে বাবুদের রবরবার কথা? তেনাদের দালানে দালানে দুগ্গাপুজো, বাবুতে বাবুতে বাবুয়ানার টক্কর, ঠাকুরদালানে দেবীর গা উপচানো জড়োয়া গয়না, ডজনখানেক ঢাক-কাঁসরের কান ফাটানো হররা। বাবুদের বারমহলে বাড়ির বউঝি-গিন্নিবান্নি-মাসিপিসি-বনগাঁবাসীদের জন্য রামকথা-কথকতার আসর, বিদ্যেসুন্দর পালা; অন্দরের রঙদার মজলিশে বাবুর ফক্কড় মোসায়েবরা বসে। আর, বাবু যাদের মোসায়েব, সেই সাহেবসুবোদের ভিড়। হাতের পেয়ালে পেয়ালে শোভাবাজারের স্বদেশি সাকি ঢেলে দিচ্চে লাল টুকটুকে বিলিতি শরাব। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ফুলটুস ঢুকু ঢুকু চলছে, চোখ লালটুস হয়ে ঢুলুঢুলু হচ্চে। কিন্তু, মনটা আসর থেকে কেবলই পালাই পালাই কচ্চে, শুধু বাবুরা ঠাট বজায় রাখতে আর মোসায়েব মোসায়েবী বজায় রাখতে উঠতে পারচেন না কিচুতে। মনটা খালি কইছে : কী যেন নেই, কী যেন নেই! তার অভাবেই মৌতাতের ভাঁড়ারে ভনভন নচ্ছার মাছি! সে আর কিচুতেই জমচে নাকো। জমবে কী করে, ফি-বার যে বাঈনাচের ঠমক, বাঈজির সুর্মাচোখের খমক মৌতাতে অমিত্তির ঢেলে শিবনেত্রের চুপড়ি উপুড় করে; সেই বাঈনাচই যে এবার ফুল অফ!

bai-2

না না, কেউ ফতোয়া দেয়নিকো। আসলে, বাঈদের মধ্যি মুসলিম জেনানারা হচ্চেন দলে ভারি। হিন্দুও আচেন কিচু, তবে কিনা তাঁদের জুড়িদার-বাজনদারেরা সব মোছলমান। তেনারা সদলে এক্কেরে পষ্ট করে কয়ে দেছেন যে, মহরমের শোকপরবে কিচুতেই বাবুর বাড়ির পুজোর ম্যহফিলে নাচাগানা করবেননি! হক কথা, তাদের শোকের পরবের কালে আনন্দের নাচাগানা কর্বেই বা কেন তারা! কিন্তু, তাই শুনেই কলকেতার বাবুদের কেতায় আগুন, মাথায় হাত, বেজায় মনখারাপ, মৌতাতে মাছি! হা কেষ্ট, কী হবে এবার, এ যে বাবুদের চোদ্দপুরুষের বনেদ নিয়ে টানাটানি! 

 bai-1

বাবুরাও সহজে কাবু হয়ে হাল হারাবার পাত্র নন।  মেজাজটাই তাঁদের আসল রাজা, শখটি তাঁদের রাজপাট। কড়ি ফেললে বাঘের দুধ জোটে, বাঈ তো কোন ছার! অম্নি কড়ির লোভ দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে ম্যানেজ করে তাঁরা বাঈ জোগাড় করতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। মনের ভেতর সব্বার আইঢাই, কী হয় কী হয়, কে কাকে দেয় টেক্কা! শেষমেশ মোয়াই সব্বাইকে ব্যোমকে দিলেন বাবু গোপীমোহন দেব। সব্বাই যখন হাওয়া হাতড়াচ্চেন, তখন একমাত্র তিনিই পটিয়েপাটিয়ে জোগাড় করে ফেললেন এক বাঈকে, জুটিয়ে ফেললেন জুড়িদার-বাজনদারও। কিন্তু, কথায় কয়, মন্দ কপালের ওষুধ নাই! গোপীমোহনের কপালটিও তেমনি। তাঁর বুড়ি মা আর সময় পেলেননিকো, কলকেতার তাবৎ বাবু আর তামাম বাঈদের হাপিত্যেসের নিঃশ্বাসেই বোধ হয় পুজো শুরু হতে-না-হতেই দুম করে অক্কা পেলেন! অমনি ফট করে অশৌচ হয়ে গেল। কী আপসোস, কী আপসোস! গোপীবাবুর দুগ্গাপুজোটা পরের হাতে নমো নমো করে পার হল বটে, কিন্তু, বাঈনাচের হররাটি আর হল না। মায়ের মৃত্যুর শোক বাবু হয়তো ভুলতে পেরেছিলেন তিন দিনে, কিন্তু, রুখাশুখা বাজারে বাঈনাচিয়ে কলকেতার তাবৎ উঠতি-পড়তি বাবুদের মাত করতে না-পারার শোক নিশ্চয় সারাজীবন ভুলতে পারেননি!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...