বিশ্ব মানচিত্রে আফ্রিকার যে দেশ 'সিং' এর মতো বাঁকা সেটিই 'সোমালিয়া' এবং সিং এর মতো দেখতে বলে এই দেশ 'হর্ন অফ আফ্রিকা' নামে পরিচিত। ১৯৯১ এ সরকার পড়ে গেলে সোমালিয়ার উপকূলে আধুনিক জলদস্যুতার জন্ম হয়। যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৫ এর পর থেকে জলদস্যুরা বৃহত্তর আকারে সংঘবদ্ধ আক্রমণ করতে থাকে। আফ্রিকার সমগ্র পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি জুড়ে গড়ে উঠেছিল তাদের দুর্দমনীয় আধিপত্য। এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের সাথে বাণিজ্য করতে চাইলে ভারত ও আরব সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করেই কেবল ভূমধ্যসাগরে পোঁছানো সম্ভব। আর এই পথে জাহাজগুলোকে সোমালিয়ার উপকূল অতিক্রম করতেই হয়, তাই জলদস্যুদের এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে যারা আরব ও লোহিত সাগর দিয়ে বাণিজ্য করে তাদের কাছে এই রাস্তা সবচেয়ে বিপদসংকুল জনপথ।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এই জলদস্যুতা থামে নি। কিন্তু এর সূত্রপাত কিভাবে হলো ও আজ তার পরিণতি কি সেটাই আজকের আলোচ্য। ১৬৫০ -১৭৩০ পর্যন্ত জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ। সেসময় ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য বিস্তারে সমুদ্রপথে একাধিক অভিযান করতো। এই সময় জাহাজের কর্মীদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো, যদিও বিনিময়ে তারা না পেত মজুরি, না খাবার, আবার শাস্তি স্বরূপ সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হতো। এর প্রতিবাদই আধুনিক যুগের সোমালিয়ার জলদস্যুতার সূচনা বলা যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে জলদস্যুতাকেই তারা বেছে নেয়। এর জন্য তারা গর্বিত ও দেশীয় মানুষদের কাছে নেতার তুল্য জনপ্রিয়।
১৯৯১এ সরকার পড়ে গেলে বেশ কিছু ইউরোপীয় জাহাজ সমুদ্র উপকূলে ঘোরাফেরা করতে থাকে। তারা সুযোগ বুঝে বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে, যা উপকূলে ভেসে আসে। এইগুলো ছিল নানা রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয়, হাসপাতালের বর্জ্যে পরিপূর্ণ। ইউরোপীয়রা মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় এই বর্জ্য ফেলতো সোমালিয়ায়। এর প্রভাব সোমালীয়রা বোঝে যখন উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ ক্রমেই রোগাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে সুনামির পর এর প্রাদুর্ভাব সাংঘাতিক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এদের ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি, এমনকি এসব ফেলা বন্ধের কোনো চেষ্টাই করা হয় নি।
সোমালিয়ার একমাত্র ব্যবসা ছিল সামুদ্রিক মাছ। এই সময় কিছু ইউরোপীয় জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র লুঠ করা আরম্ভ করে। ৩০০ মিলিয়ন মূল্যের মাছ প্রতি বছর বিভিন্ন ইউরোপীয় জাহাজ নিয়ে যায়। ফলে স্থানীয় জেলেরা অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যেই পড়ে। তারা তাদের মতো করে চেষ্টা করে স্পীড বোট নিয়ে জাহাগুলি তাড়া করে সীমা পার করলেও প্রতিনিয়ত এ অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষে বেআইনি মাছ ধরা ও বর্জ্য ফেলার জন্য কর বসানোর চেষ্টা করা হলেও কাজ হয় নি। এই সোমালীয় জেলেরা ঠিক করে তারা বর্জ্যবাহী জাহাজ না তাড়িয়ে আটক করবে। এই কাজে সাফল্য তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তারা পরবর্তী প্রতিবাদের পদক্ষেপ হিসেবে জাহাজগুলো ছিনতাই করে মুক্তিপণ দাবি করার সিদ্ধান্ত নেয়। আইনি পথে সাড়া না পেয়ে এই ব্যবস্থা নেয় এবং বাস্তবিক পরিস্থিতি তাদের প্রকৃত জলদস্যুতে রূপান্তরিত করে। সামুদ্রিক জ্ঞান সম্মক থাকায় তারা জলদস্যু দল গড়ে তোলে। এই সময় থেকে তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে।
মোবাইল, স্যাটেলাইট ফোন, জি পি এস, রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড, সোলার সিস্টেম, আধুনিক স্পিড বোট, এসল্ট রাইফেল, শট গান অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে তারা আক্রমণ চালায়। গভীর সমুদ্রে তারা মাদার শিপ থেকে অভিযান পরিচালনা করে। আর বড় জাহাজের কাছে পৌঁছাতে তারা স্পিড বোটের সাহায্য নেয়। এতে আধুনিক অস্ত্র থাকলেও বেশি থাকে ইঞ্জিনের জ্বালানি। আক্রমণের সময় রাত বা ভোরের দিককে বেছে নেয় তারা, ছোট স্পিড বোট জাহাজের রাডারে ধরা পড়ে না, কারণ তারা পিছন থেকে আক্রমণ করে। কিন্তু দেখতে পেলে তারা জাহাজ থেকে গরম জল স্প্রে করে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করলেও কাজ হয় না। তারা দস্যু কবলিত হয় খুব সহজেই। জলদস্যুরা মার্কিন বিলের মাধ্যমে মুক্তি পণ আদায় করে।
জনগণের কাছে তাদের এই জলদস্যুতাই উপকূল রক্ষার একমাত্র কৌশল। আরো তাৎপর্যপূর্ণ হলো সোমালিয়া এমন একটি দেশ যেখানে কোনো সেনাবাহিনী নেই, এই জলদস্যুরাই প্রতিরক্ষা দেয়। তারা নিজেরাও গর্বিত কারণ তারা দেশীয় সম্পদ রক্ষা করছে। ফলে ২০০০ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক জাহাজগুলির কাছে সোমালিয়া আতঙ্ক। এই জলদস্যু এখানকার স্থায়ী, স্বীকৃত পেশা। ২০১৩ সালে এদের দাপট কিছুটা কমেছে, কিন্তু একেবারে বন্ধ হয় নি। কারণ দীর্ঘ বঞ্চনার স্বীকার হয়ে তারা কিছুটা বাধ্য হয়েই এই পেশাকে গ্রহণ করেছে। যদিও এই পেশাই তাদের দিয়েছে স্বচ্ছলতা, দিয়েছে বাঁচার মানে ও আত্মবিশ্বাস।