পুরাণ আলোকে বনভোজন

‘সর্ব্বপাপবিমুক্ত্যর্থং বনভোজনমুত্তমম্।

কৃত্বৈবং সকলং কর্ম্ম কৃষ্ণায় চ সমর্পয়েৎ।।

অশ্বমেধসহস্রস্য রাজসূয়শতস্য চ।

যৎফলং সমবাপ্নোতি তৎফলং বনভোজনে।।’

(‘স্কন্দ পুরাণ’)

অর্থাৎ,

‘সকলের পাপমুক্তির জন্য বনভোজনের মতো উত্তম ব্যাপার আর কিছুই নেই। তাতে সমস্ত কর্মফল শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করতে হয়। বনভোজন করলেই সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল এবং শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ করা যায়।’

‘স্কন্দ পুরাণ’-এ বিষ্ণু খন্ডের ‘কার্তিকমাসমাহাত্ম্য’ অংশে এভাবেই বনভোজনের সুফলের কথা আছে। পুরাণকার ব্যাসদেব বনভোজনকে কার্তিক ব্রতের অত্যন্ত আবশ্যিক উপসংহার বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কার্তিক ব্রত কী?

 

কার্তিক মাস বিষ্ণু-হরি-কৃষ্ণের প্রিয় মাস। কেননা, এই মাসেই শঙ্খাসুরকে বধ করে তার কবল থেকে চারটি বেদকে উদ্ধার করেছিলেন বিষ্ণু। তার কোপ থেকে দেবতাদের রক্ষা করেছিলেন। এই মাসেই বিষ্ণুর দুই প্রিয় বৃক্ষ ও গুল্ম আমলকি ও তুলসীর জন্ম হয়েছিল। তাই বিষ্ণুভক্তেরা কার্তিক মাসে কার্তিক ব্রত উদযাপন করে বিষ্ণুকে তুষ্ট করে মোক্ষলাভ করেন। এই ব্রতে গলায় আমলকি ও তুলসীমালা ধারণ করতে হয়। তুলসী বা আমলকিতলায় রাধাদামোদরের নিত্য পুজো করতে হয়। পুষ্প ও দীপদান করতে হয়। আমলকিতলায় হরিকথা শুনতে হয়। কার্তিকমাসমাহাত্ম্যকথা শুনতে হয়। ব্রাহ্মণ ভোজন ও তাদের দান করে নিজে ভোজন করতে হয়। এটি শাস্ত্রীয় ব্রত। এই ব্রতের অনেকগুলো ব্রতকথা আছে। তার মধ্যে একটি আপনাদের শোনাচ্ছিঃ

 

সে অনেককাল আগের কথা। কাবেরী নদীর উত্তর তীরে এক জনপদ ছিল। সেখানে দ্বিজশর্মা নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি নিজে বেদ ও নানান শাস্ত্রে পণ্ডিত হলেও তাঁর পুত্রটি ছিল মহাপাপিষ্ঠ। এমন কোন দুরাচার ছিল না, যেটা সে করেনি। কাজেই, নিজে পণ্ডিত হয়েও কুপুত্রভাগ্যে ব্রাহ্মণের লজ্জার শেষ ছিল না।

 

কার্তিক মাস এল। এই মাসে কার্তিক ব্রত করলে সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে মানুষ পবিত্র হয়। ব্রাহ্মণ ভাবলেন যে, ছেলেকে এই ব্রত করিয়ে তাকে শুদ্ধ করিয়ে সৎপথে আনবেন। কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ছেলেকে ব্রতের কথা বলতেই, সে তো একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়ে তেরিয়া হয়ে উঠল। বাপকে যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগাল শুরু করল। তাতে ব্রাহ্মণ খুব রেগে গেলেন। তাঁকে রাগতে দেখেও ছেলে যখন থামল না, তখন তিনি অভিশাপ দিয়ে বসলেন। বললেন, ‘ওরে নির্বোধ, তুই ইঁদুর হয়ে গাছের কোটরে বাস কর গে যা!’ অভিশাপ শোনার পরই পাপিষ্ঠ পুত্রের টনক নড়ল। সে পিতার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল এবং মুক্তির উপায় জানতে চাইল। তার অনুনয়ে ব্রাহ্মণের রাগ পড়ল। যতই যাই হোক, পুত্র তো; মনে তাই দয়া এল। বললেন, ‘পুত্র, কার্তিক মাসে বনের মধ্যে যে-দিন হরিকথা শুনতে পাবে, সে-দিনই তোমার মুক্তি হবে।’

 

ব্রাহ্মণের কথা শেষ হতে-না-হতেই পুত্র ইঁদুর হয়ে কাবেরী তীরের বনে চলে গেল। সেখানে একটি গাছের কোটরে বাস করতে শুরু করল। অপেক্ষা করতে লাগল সেই পুন্যব্রতীর, যে তাকে কার্তিক মাসে হরিকথা শোনাবে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটে গেল কয়েক হাজার বছর।

 

তারপর এল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত কার্তিক মাস। ঋষি বিশ্বামিত্র শিষ্যদের সঙ্গে একদিন সেই বনে এলেন। কাবেরী জলে স্নান করে একটি আমলকি গাছের নীচে হরির পুজো করলেন। তারপর শুরু করলেন কার্তিকমাসমাহাত্ম্য শোনাতে। এক নিষ্ঠুর ব্যাধ সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে বিশ্বামিত্রকে প্রনাম করে জিজ্ঞেস করল, ‘হে মুনিশ্রেষ্ঠ, আপনারা এখানে কী করছেন?’ বিশ্বামিত্র বললেন যে, তাঁরা কার্তিক ব্রত করছেন। তারপর ব্যাধের জিজ্ঞাসায় আরও ব্যাখ্যা করে কার্তিক ব্রতের মাহাত্ম্য, ব্রতপালন বিধির বিবিধ কথা বললেন। তারপর শোনাতে শুরু করলেন হরিকথা। গাছের কোটর থেকে বিশ্বামিত্রের মুখে হরিকথা শুনে ইঁদুরদেহী ব্রাহ্মণপুত্র বেরিয়ে এল আরও ভালো করে শুনতে। আমলকিতলায় এসে বসল। বিশ্বামিত্র হরিকথা শেষ করতেই ইঁদুরের শাপমুক্তি হল। সে দিব্য দেহ ধারণ করল। তাকে নিয়ে যাবার জন্য স্বর্গ থেকে নেমে এল রত্নখচিত রথ। তা দেখে বিশ্বামিত্রসহ সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। তখন ব্রাহ্মণপুত্র নিজের পূর্ববৃত্তান্ত জানিয়ে তারপর স্বর্গে গেল। ব্যাধ এই ব্রতের এমন প্রত্যক্ষ ফল দেখে নিষ্ঠা ভরে ব্রতপালন করল। ব্রত শেষে সেও মুক্তি পেয়ে স্বর্গে গেল। ব্রতকথাও এখানে শেষ হল।

 

ব্রতের গল্পের মধ্যে বনভোজনের কোন উল্লেখ নেই। আছে শুধু বনে গিয়ে আমলকিতলায় বসে হরিপুজো, কার্তিকমাসমাহাত্ম্য শ্রবণ, হরিকথা শ্রবণ এবং ব্রতপালনের কথা। তবু, এই ব্রতপালনেরই একটি বিশিষ্ট ও পরিশিষ্ট অঙ্গ হল, বনভোজন। ব্যাসদেব গল্পের বাইরের শ্লোকসমূহে সে-কথাই অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন। বলেছেন, কার্তিক ব্রত শেষ হবে বনভোজনের মধ্য দিয়েই।

 

ব্যাসদেব বলেছেন যে, দশমী, দ্বাদশী, পূর্ণিমা বা পঞ্চমী তিথিতে এই বনভোজন করতে হবে। আম, বক, অশ্বত্থ, নিম, কদম্ব, বট এবং তেঁতুল গাছ সমন্বিত আমলকি বনে বনভোজনের জন্য যেতে হবে। আমলকি গাছের একেবারে গোড়ায় বেদী তৈরি করে হরিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তার ওপর বসাতে হবে। স্নান-পুজো করে আগুন জ্বেলে পায়েস রান্না করতে হবে। তারপর ঘি, গুড় এবং পলাশ কাঠ দিয়ে হোমযজ্ঞ করে ধাত্রী অর্থাৎ আমলকি, শান্তি, কান্তি, মায়া, প্রকৃতি, বিষ্ণুপত্নী মহালক্ষ্মী, রমা, কমলা, ইন্দিরা, লোকমাতা, কল্যাণী, কমলা, সাবিত্রী, জগদ্ধাত্রী, গায়ত্রী, সুধৃতি, অন্তজ্ঞা, বিশ্বরূপা, সুরূপা প্রভৃতি শাস্ত্রীয় দেবীদের এবং বনদেবতার পুজো করতে হবে। পুজো শেষ হলে ব্রাহ্মণদের চন্দন দান করে ভোজন করিয়ে সব শেষে বন্ধুদের সঙ্গে ব্রতীকে ভোজন করতে হবে। ব্যাসদেব বনভোজন যেমন বন্ধুদের সঙ্গে উদযাপন করার বিধান দিয়েছেন, তেমনি পরিবার বা গ্রামবাসীদের সঙ্গেও উদযাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

ভারতীয় পুরাণসমূহে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচারমাত্রকেই ঈশ্বরসেবা ও ব্রতের আধার হিসেবে দেখা হয়েছে। সেভাবেই তাকে পরিবেশন করা হয়েছে। ‘বনভোজন’ নামক পারিবারিক এবং সামাজিক উদযাপনটিকেও হয়তো সেভাবেই কার্তিক ব্রতের মধ্যে আত্তিকরণ করা হয়েছে। কিংবা, এমনও হতে পারে যে, ‘বনভোজন’ আদিতে কার্তিক ব্রতেরই অংশ ছিল, কালে কালে ধর্মাচার বিযুক্ত হয়ে আজকের নিছক ও নির্ভেজাল আনন্দযাপনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কার্তিকের আচার এখন পুরো শীতকালের আচার হয়ে উঠেছে। যাই হোক না কেন, ‘বনভোজন’ যে অ্যাডভেঞ্চারধর্মী প্রাচীন একটি সামাজিক এবং পারিবারিক মিলন-উদ্যোগ, তা অস্বীকার করা যায় না।       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...