আচারের সাতকাহন

আজ আচারের সমাচার। আমেরিকার আবিষ্কারের কৃতিত্ব ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের পর যদি কেউ পেয়ে থাকে তাহলে, তা পাবে আচার!  কলম্বাসের পরে নয় বরং তাঁর থেকেও কিছুটা বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য আচারের, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানে কলম্বাস তাঁর নাবিকদের প্রতিদিন রেশন হিসেবে আচার দিতেন। এই আচারই তাদের ভিটামিন সি-এর অভাব মিটিয়ে স্কার্ভি রোগের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। তাই তারা সংক্রমণজনিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পায় এবং অভিযানও সফল হয়।

আচার প্রাচীন প্রযুক্তির সাক্ষ্য বহন করে, যখন ফ্রিজ ছিল না, ড্রাইয়ার ছিল না, হিমঘরও ছিল না, তখন ফল বা সবজিকে এমনভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হত। আচার প্রচলিত ছিল বণিক অথবা যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে, যারা দূর দূরান্তে পাড়ি দেন।

ইতিহাসবিদদের মতে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম খাবার আচার, যার বয়স সাড়ে চার হাজার বছরেরও বেশি। ২,৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সময় থেকে মানুষ আচার খাওয়া শুরু করে। পৃথিবীর প্রাচীনতম আচারের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শসার তৈরি আচারের কথা। মনে করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সনে মেসোপটেমিয়ায় শসার আচারের প্রচলন ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী, সৌন্দর্য্য অক্ষত রাখার জন্য রানি ক্লিওপেট্রা নিয়মিত আচার খেতেন। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জিনিসের আচার তৈরি করা হয়। শুধু ফল কিংবাংবা সব্জি নয়। বিভিন্ন ধরণের মাংস, মাছ এবং ডিমেরও আচার তৈরি করা হয়। কোন কোন দেশে মাংসেরও আচার তৈরি করা হয়। আচার তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুল্ম শুলফা প্রথম ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা থেকে পশ্চিম ইউরোপে আসে নবম শতকে। ১৬৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শসা থেকে আচার তৈরি করে ব্যারেলে করে বিক্রি করা হত দেশে-বিদেশে। আমেরিকাতে ২০০১ সাল থেকে ১৪ই নভেম্বর দিনটিকে আচারের দিন বা Pickle Day হিসেবে পালন করা হয়। এই দিন সকলে খাবারের সাথে আচার খায় আর একে অন্যকে আচার উপহার হিসেবে পাঠায়।

বাংলার সাথে আচারের সম্পর্ক অতি নিবিড়, তবে আজকের বেঙ্গলী থালি খাওয়া বাঙালি তার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবে না। ভারতের উত্তর পশ্চিমের রাজ্যগুলি আচার বানাতে খুবই পটু, বিশেষ করে রাজস্থান এবং গুজরাত! আচার বানাতে তাদের জুড়ি মেলা ভার! আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমভারতের নাম। সুলতানি আমলে মানসিংহের হাত ধরে বাংলায় প্রবেশ ঘটে আচারের। আগে বাঙালি আচার তৈরির পদ্ধতি ও স্বাদ জানত না। বিভিন্ন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ থাকলেও আচারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পশ্চিমভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় রাজস্থান, পাঞ্জাবের মানুষের আনাগনা হয়। তাদের সংস্কৃতিতে আচারের প্রচলন রয়েছে। কারণ মরুভূমি অঞ্চলে সেইভাবে চাষবাস হয় না। আচারের মাধ্যমে নানাধরনের সবজিকে সংরক্ষণ করা হয়। পশ্চিম থেকেই পুবে আসে আচার।

মাছে-ভাতে বাঙালির কিন্তু নিজের আচার হল তেল আচার, রোদে সানবাথ খাওয়ানো! ছাদে বোয়ামে রাখা আচার আর তা চুরি করে খাওয়া, হাল বাঙালির স্মৃতিতেই স্থান পেয়ে গিয়েছে, বই আর সিনেমায় কেবল তা দেখা যায়, বাস্তবে লোপ পেয়েছে। বাংলায় আচার হয় টক, মিষ্টি, ঝাল, টক-ঝাল-মিষ্টি। লেবু, আমড়া, জলপাই, আমলকি, তেঁতুল, কুল, চালতা, আনারস, কামরাঙ্গার মত টক জাতীয় ফল ছাড়া ও বিভিন্ন ধরনের সব্জি যেমন গাজর, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, মূলো, টমেট, বরবটি, ইঁচড় দিয়েও আচার করা হয়। এই গরমকাল এখনই আচারের সঠিক সময়। টকের স্বাদে মন মজিয়ে গরমের সাথে জমিয়ে ব্যাটিং করুন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...