ব্যালকনি বা ছাদবাগানে শীতে চাষ করুন অপূর্ব-সুন্দরী পিটুনিয়া

শীতের বাগান ফুলের সজ্জায় সাজিয়ে তুলতে পিটুনিয়ার জুড়ি নেই। হলুদ, সাদা, লাল, বেগুনি, গোলাপি, ঘিয়ে প্রভৃতি যত রকমের স্নিগ্ধ রঙ আছে; সব রঙেরই পিটুনিয়া পাওয়া যায়। তার প্রতিটি রঙের বিভিন্ন শেড যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় দুই রঙের পিটুনিয়াও। তাই তার এমন বিবিধ রঙের বিচিত্র বাহারকে কাজে লাগিয়ে অপূর্ব সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেওয়া যায় সাধের ছাদ ও ব্যালকনিবাগান। পিটুনিয়া যেহেতু গুচ্ছমূলজাতীয় ফুলের গাছ, তাই এদের হ্যাঙ্গিং পটে খুব ভালোভাবে চাষ করা যায় এবং বারান্দা ও ব্যালকনিতে ঝুলিয়ে রেখে অসাধারণ সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায়। লক্ষ্মীশ্রীতে সাজিয়ে তোলা যায় বাড়ি ও বাগান।

ছাদ ও বারান্দায় চার-পাঁচ ঘন্টা বেশ ভালো শীতের রোদ যদি আসে; তাহলে সেখানে অনায়াসেই পিটুনিয়া চাষ করা যায়। আগেই বলেছি যে, পিটুনিয়া একরঙা ও দুই রঙা—রঙের বিচারে এই দুই জাতের পাওয়া যায়। তবে হরেক রকম রঙের মাঝে সবচেয়ে বেশি ফুল দেয় সাদা রঙের পিটুনিয়া। আবার পাঁপড়ির বিচারে পিটুনিয়া হয় দু’রকমের—সিঙ্গল পাঁপড়ি এবং ডবল পাঁপড়ি। সিঙ্গল পাঁপড়ির পিটুনিয়াতে ডবলের চেয়ে অল্পদিনে ও আগে ফুল আসে। আপনি গাছবিক্রেতার কাছে গিয়ে আপনার যে রঙ পছন্দ সেই রঙ এবং ডবল বা সিঙ্গল পাঁপড়ি—যে ধরণের ফুল আপনার পছন্দ সেই অনুযায়ী চারা চেয়ে নেবেন। এবং অবশ্যই থাম্বপটের চারা নেবেন। আর দেখে নেবেন যে, চারাটি যেন অবশ্যই হাইব্রিড ভ্যারাইটির হয়।

থাম্বপটের চারা এনে বাড়ির আবহাওয়া মানিয়ে নেওয়ার জন্য দু-তিনটে দিন শেডে রাখুন। থাম্বপটের মাটি শুকোলে তবেই মাটি ভেজার মতো জল দিন। ব্যস, বাড়তি আর কিচ্ছু দেবেন না। তিনদিন পর আট থেকে দশ ইঞ্চি টবে বা পটে এই চারা রোপণের জন্য উদ্যোগ নিন। পিটুনিয়া ঝোপযুক্ত গাছ এবং তার শেকড় যেহেতু গুচ্ছমূল; চারপাশে ছড়ায়, নীচের দিকে বেশি যায় না—তাই চওড়া মুখযুক্ত চার থেকে ছয় ইঞ্চি গভীর টব বা পট তার জন্য এক্কেবারে আদর্শ। 

পিটুনিয়া দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে দেড় ভাগ বালি ও এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে নিলেই তার জন্য সেই প্রয়োজনীয় দোআঁশ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি আদর্শ, কেননা এর জলধারণ ক্ষমতা কম। গাছের গোড়ায় জল জমে থাকাটা পিটুনিয়া একদম পছন্দ করে না। গোড়া পচে, ছত্রাকের আক্রমণে সে মারা যায়। অনেকে এটা মাথায় রেখেই কোকোপিটে পিটুনিয়া চাষ করেন। তাতে ভালো হয়। আপনিও চাইলে তাতে করতে পারেন। তবে আমি বলি কী, হাতের কাছে মাটিসংগ্রহের সহজ উপায় থাকলে কোকোপিটের পেছনে বাড়তি খরচ না-করে পিটুনিয়া মাটিতেই করুন।  

পিটুনিয়া গাছে যেহেতু ছত্রাকের আক্রমণ খুব বেশি হয়, তাই মাটি তৈরির সময়ই আধ চামচ ফাঙ্গিসাইড ভালোভাবে মেখে তার সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর টবের ফুটোয় খোলামকুচি দিয়ে তার ওপর পাথরকুচি ও বালি দিয়ে দুই থেকে তিন ইঞ্চির লেয়ার তৈরি করে নিতে হবে। টবের বাড়তি জল নিকাশের জন্য এভাবে এই লেয়ারটা তৈরি করা একান্তই আবশ্যক। এর ওপর মিক্স করা মাটিটা দিয়ে টবের আশিভাগ ভর্তি করে নিতে হবে। পরবর্তীতে জল দেওয়া, সার দেওয়া, নতুন কিছু মাটি যোগ করা প্রভৃতির জন্য টবের ওপরের দিকে এই কুড়িভাগ জায়গা ফাঁকা রাখা হয়। যাই হোক, টবে মাটি ভর্তি করার পর এ-দিন টবটা এভাবেই রেখে দিতে হবে, যাতে চারা রোপণের আগেই ছত্রাকনাশক মাটিতে থাকা ছত্রাকজাতীয় জীবাণু পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলতে পারে। ছত্রাকনাশককে নাশকতার এই সময়টুকু দিয়ে টবে চারা রোপণ করতে হবে পরদিন।

টবের মধ্যিখানে গর্ত করে সাবধানে চারা বসাবেন। চারার চারপাশ ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর মাটি ভেজে এরকম জল দেবেন। তিনদিনের জন্য টবশুদ্ধ গাছটি ছায়ায় রেখে দেবেন। মাটি এই সময়কালে শুকবে না, তাই রি তিন দিনে জল আর দেওয়ার দরকার নেই। চারদিনের দিন টবটি এনে তার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা রোদযুক্ত জায়গায় বসিয়ে দেবেন। টবে চারা বসানোর পর দু’সপ্তাহ পর্যন্ত কোন খাবার দেবেন না। খাবার দেওয়া চালু হবে দু’সপ্তাহ পর। খাবার চালু হলে সপ্তাহে একদিন খোলপচা জল দেবেন। ভালো হয় পেন্সিল খোল (পেন্সিলের মতো লম্বা লম্বা আকারের দেখতে) বা বাদাম খোল পচিয়ে দিতে পারলে। পেন্সিল খোল দু’দিন পচাবেন, বাদাম খোল একদিন। এ-দুই খোল হাতের কাছে না-পেলে সরষের খোল তিনদিন পচিয়ে দেবেন। তাতেও বেশ ভালো কাজ হয়। হাফ লিটার জলে পঞ্চাশ গ্রাম খোল পচাবেন। পচা খোল জলশুদ্ধু ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকবেন। ছেঁকে নেওয়ার পর যে তরলটা পড়ে থাকবে, সেটা যদি এক মগ হয়, তাহলে তার সাথে আরও ছ’মগ সাধারণ জল ভালোভাবে মিশিয়ে পাতলা করে সেই জল গাছের গোড়ায় দেবেন। মনে রাখবেন, মিশ্রণের অনুপাত হচ্ছে ১ এর সঙ্গে ৬। মনে করে এই মিশ্রিত পাতলা জলের সঙ্গে ফাঙ্গিসাইড এক চা-চামচ মিশিয়ে নেবেন। সপ্তাহে একবার এটুকু ডোজ পেলেই গাছে ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণের আর সম্ভাবনা থাকবে না।

খোলপচা জল দেওয়ার পাশাপাশি পনেরো দিন পর পর এক চামচ ইউরিয়া, দু’চামচ পটাশ আর আট চামচ সিঙ্গল সুপার ফসফেট গুঁড়ো একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে টব প্রতি গাছের গোড়া থেকে দূরে এক চামচ করে ছড়িয়ে মাটি খুঁচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। যখন এই সার দেবেন, তখন মাটি যেন হালকা ভেজা ভেজা থাকে। ব্যস, এভাবে জৈব ও রাসায়নিক খাবার নিয়ম করে দিয়ে গেলেই হবে, এর বাইরে আর কিছু দিতে হবে না। তাতেই প্রচুর ফুল হবে, দেখবেন। পিটুনিয়াতে খুব একটা পোকামাকড়ের আক্রমণের ভয় নেই। ফলে, সে ব্যাপারে চিন্তা করার দরকার নেই।

আগেই বলেছি যে, পিটুনিয়া জমা জল পছন্দ করে না। তাই মাটি শুকিয়ে আসছে, এমন অবস্থা হলে তবেই জল দেবেন। এমন পরিমাণ জল দেবেন, যাতে শুধু মাটি বেশ ভালোভাবে ভিজে যায়, জল একটুও জমে না-থাকে। এই গাছ বেশ ঝাঁকড়া ও ঝোপালো হয়, তার ডালপালার অধিকাংশই টবের মাটির সঙ্গে এক্কেবারে লেপ্টে থাকে। এর ডালপালা ও কান্ড-পাতা সবই খুব নরম। তাই জল জমে থাকলেই মাটির স্পর্শে খুব তাড়াতাড়ি ছত্রাকের আক্রমণ শুরু হয়ে যায়, আর সেগুলোতে পচন ধরিয়ে দেয়। তাই জল দেবেন মাটিতে রস আছে কিনা ভালোভাবে দেখে, তারপর।

পিটুনিয়ার যত ডাল হবে, ততই ফুল হবে। তাই ছোট থেকেই ডালের ডগা কেটে শাখার পরিমাণ বাড়াতে হবে। নিয়মিত ডগা পিঞ্চ করলে খুব অল্পদিনেই পিটুনিয়া বেশ ঝাঁকড়া হয়ে যায়। পিটুনিয়াতে বেশি ফুল পেতে গেলে আর-একটা জিনিস খুব কেয়ারফুলি করতে হবে, সেটা হচ্ছে, এর কোন ডাল তরতর করে একাই লম্বা হয়ে বেড়ে হাত-ছাড়াচ্ছে দেখলেই তাকে টুক করে কেটে ফেলতে হবে। কাটা অংশ থেকে ছোট ছোট ডাল গজাবে তখন, এবং তাতে গুচ্ছের ফুল ফুটবে।

এখন পিটুনিয়া রোপণ করলে নভেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষদিকে কুঁড়ি আসতে শুরু করে। গাছে কুড়ি এসে গেলে ডগা পিঞ্চ করা বন্ধ করে দিতে হবে। তবে ফুল ফুটতে শুরু করলেই আপনার একটি কাজ কিন্তু বাড়বে। পিটুনিয়া এক দিনের ফুল। তাই ফুলটি মরে গেলেই আপনাকে অমনি সেই ফুলটি বৃতিসহ ছিঁড়ে বা কেটে ফেলে দিতে হবে। এটা না-করলে বা মরা ফুল গাছে থেকে গেলে গাছে বেশি ফুল আসবে না; অকালেই গাছ বুড়ি হয়ে ফুল দেওয়া কমাতে কমাতে শুকিয়ে মরে যাবে। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন আগের দিনের মরা ফুল বৃতিসহ তুলে আপনাকে ফেলতেই হবে। এটা করলে আপনার গাছ আরও আরও বেশি করে ফুল দিতে থাকবে এবং আপনার বাগান ভরিয়ে রাখবে।

পিটুনিয়া শীতের ফুল। তাই মার্চের শুরু পর্যন্ত যেখানে তাকে শুরু থেকে রেখেছেন, সেখানে থেকেই সে আপনাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে রাখবে, চিন্তা নেই। চিন্তা শুরু গরম পড়লেই। তখন তাকে ওই ফুলসানলাইটে আর রাখা যাবে না। রাখলে তাতেই সে ধীরে ধীরে অল্পদিনে মরে যাবে। কিন্তু যদি তাকে টবশুদ্ধ এই সময় শেড বা ছায়ায় সরিয়ে দেওয়া যায় এবং আগের খাবার নিয়ম করে চালিয়ে যাওয়া যায়; তাহলে সে মে মাস পর্যন্ত আপনাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে রাখবে।

পিটুনিয়া বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষ করা যায়। তাই গরম পড়তে শুরু করলেই আপনি পরের বছরের জন্য পিটুনিয়ার বীজ সংগ্রহ করতে শুরু করে দিন। এটার জন্য আপনাকে প্রথমেই যেটা করতে হবে সেটা হল, মরা ফুল বৃতিসহ তুলে বা ছিঁড়ে ফেলার বাড়তি কাজটি বন্ধ করে দিতে হবে। ফুলের বৃতির অংশটি পুষ্ট হয়ে যখন ক্রমে শুকিয়ে যাবে; তখন সেটি সংগ্রহ করবেন। সেটা ভাঙলেই তার মধ্যে দেখতে পাবেন ক্ষুদে ক্ষুদে সরষের দানার মতো অনেকগুলো বীজ। এই বীজগুলো সংগ্রহ করে একদিন রোদে দিয়ে এয়ারটাইট পাউচে বা কৌটোয় রেখে দেবেন। জুন বা জুলাই মাসে দোআঁশ মাটি ভরা সরা বা টবে বুনে দেবেন। ক’দিনেই দেখবেন সেই বীজ থেকে নতুন চারা বেরিয়েছে। তখন আর কী, চারাদের পরিচর্যা করে একটু বড় করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আট-দশ ইঞ্চির টবে বসিয়ে দেবেন, ব্যস। দেখবেন, নিজে বীজ থেকে চারা তৈরি করে বাগান সাজিয়ে ফুল ফোটানোর আনন্দই আলাদা।...                            

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...