উষ্ণ মণ্ডলেই এদের চারণ ক্ষেত্র। শুষ্ক অঞ্চল গুলিতে জলের অভাবে গাছেদের ঘনত্ব হয় কম। গাছ কম হওয়ার অর্থ কৃষিজ ফসলের চাষও কম হওয়া।কৃষিজ ফসল না থাকা মানে এরাও ভিড়বে না সেদিকে। ভিড়লে খাবে কী? শস্য, ফসল এসব খুঁটে খেয়েই জীবনধারণ তাদের। সবুজের মেলা তাদের আকর্ষণ করে বরাবর। যেখানেই সবুজের শামিয়ানা, সেখানেই কাতারে কাতারে ধেয়ে আসছে তারা।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর চ্যানেলে দেখানো সেই মজার দৃশ্য! একদল পর্যটক রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। চোখ, মুখ ঢেকে সবার দৃষ্টি কিছু খুঁজছে যেনো। হট করেই শোঁ-শোঁ আওয়াজ একটু দূর থেকেই। অমনি মাথা নিচু সকলের। ঝড়ের গতিবেগে চলে গেলো তারা।পঙ্গপাল। টলিয়ে দিতে পারে কোনও দেশের অর্থনীতির হালচাল। পৃথিবীর অন্য কোনও প্রাণী প্রকৃতির খাদ্য ভান্ডারের এমন ক্ষতি করতে পারেনা। হ্যাঁ, শুনলে অবাক হবেন একশো জন মানুষ হয়ত যে ক্ষতির কথা ভাবতেও পারবেননা, পঙ্গপালের দল সেই পরিমাণ ধ্বংস সাধন কয়েক মুহূর্তেই ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
নতুন ধরনের পঙ্গপালের ১০ লাখ পতঙ্গের একটি ঝাঁক একদিনে ৩৫ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। ঘাসের গন্ধ এদেরকে আমন্ত্রণ জানায় অনেক দূর থেকেই। গন্ধ পাওয়া মাত্রই দল গঠন করে ধাওয়া করে সেই গন্ধের উৎস স্থলে। এদের না আছে সংসার, না আছে কোনও বন্ধু ও স্বজন। একাই থাকে সকলে। খাওয়ারের খোঁজ পেলেই দল গঠন করে। চলার পথে যা কিছু চোখে পড়ে, তাই খায়। এ যেনো চোখের খিদে! যতদিন পাখা গজায় না, ততদিন চিন্তার কোনও অবকাশ নেই। যেই না পাখা চিনলো, শিখল উড়তে, অমনি মেতে ওঠা ধ্বংস লীলায়।
এইসময় বেড়ে যায় খাদ্যের চাহিদাও, প্রায় তিন গুণ বেশি পরিমাণে খেতে পারে তখন। প্রায় ৬০ মাইল অবধি দূরত্ব ডানার ভরসায় পার করে দিতে পারে।বিচরণ ভূমির আয়তন পরিমাপ করলে, তা হাজার হাজার বর্গ মাইল অতিক্রম করে যেতে পারে। এক একটা দলে ভাগ হয়ে এরা উড়তে থাকে। এক একটা দল খাবার মজুত করতে পারে চল্লিশ হাজার টন।হুম্! চক্ষু চড়ক গাছ তো? ফি বছরে আপনার খাদ্যের যোগানে যে ঘাটতি, ফসলের দাম বাড়া; এসবের পিছনে কখনও সখনও পঙ্গপালও দায়ী বটে।প্রাকৃতিক ভাঁড়ারের এহেন ক্ষতি সাধন আর কেউই পারেনা করতে।
এদের প্রাণ রয়েছে খাদ্যনালীতে। হ্যাঁ সকলেরই এক অর্থে তাই, তবুও এরা খাওয়ার ছাড়া থাকতে পারেনা এক দণ্ডও। খাবার শেষ হলেই মৃত্যু অবধারিত। এই পতঙ্গ কোনও হালের আমদানি নয়। ইতিহাসের পাতা নিবিড় ভাবে ওল্টালে আজও দেখা মিলবে এদের। ইলিয়াড, বাইবেল ও কোরানেও রয়েছে এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি।ধর্মগ্রন্থে এই পতঙ্গকে ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করা রয়েছে। প্রাচীন মিসরীয়দের কবরে দেখা যায় এর ছবি।
শুষ্ক আবহাওয়ার দেশে দুর্ভিক্ষের মূল এরাই। খবর অনুসারে এই বছরে এদের সংখ্যাধিক্য দেখার মত, শতাব্দীতে সবথেকে বেশি। জরুরী অবস্থা জারি করেছে কোনও কোনও দেশ।পাকিস্তান এদের প্রভাব এড়াতে চীনের সাহায্যে আমদানি করেছিল বহু হাঁস।আসলে পূর্ব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া- সর্বত্রই এদের আনাগোনা। এবছর ভারতের গুজরাট এবং রাজস্থানেও এরা দেখিয়ে এসেছে নিজেদের আধিপত্য। তৃতীয় বিশ্বের ক্ষতির পরিমাণই অধিক। মূলত গ্রীষ্মেই এদের প্রকোপ লক্ষ্য করা গেলেও, প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে।
১৯৯৩ সালে ব্যাপক আকারে পঙ্গপালের আক্রমণের মুখে পড়ে পাকিস্তান। এই ধাপে ২০১৯ সালের মার্চে পাকিস্তানে প্রথম পঙ্গপালের আক্রমণ শনাক্ত হয়।পরে এটি সিন্ধু, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের ৯ লাখ হেক্টর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোটি কোটি টাকা মূল্যের ফসল ও গাছপালা।
আফ্রিকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে ৭ কোটি ডলারের অনুদান চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। ওমানের মরুভূমিতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেক বৃষ্টি হওয়ায় এই পঙ্গপালগুলো আফ্রিকায় চলে গিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় থেকেই এই পতঙ্গের আগমন ঘটে। বিগত ১০ বছরে ভারত সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পঙ্গপালের হাঙ্গামাও মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। এই দুইয়ের প্রভাবেই থিতু হতে হয়েছে অর্থনীতি।