বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান ‘খাদ্য’, তা সবাই জানে, সে আর নতুন কি! এই খাবার জোগাড়ের তাগিদেই প্রতিনিয়ত ইঁদুর দৌড়ে সামিল হচ্ছে মানুষ। আধুনিক উন্নত প্রগতিশীল জীবনযাত্রায় যেখানে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু খাবার অপচয় হয়, সেখানে পৃথিবীর এককোনায় তীব্র খাদ্য সংকটে দিন কাটাচ্ছে পশ্চিম হামিসফেয়ারের দরিদ্রতম দেশ হাইতি।
কিউবার পূর্বদিকে ২৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশের জনসংখ্যা ১ কোটি দশ লক্ষ। ইউনাইটেড নেশন-এর ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’-এর মতে প্রতিদিন সারা বিশ্বে খাবার নষ্ট হয় ১.৩ বিলিয়ন টন, যাতে বার্ষিক খতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার, সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। কিন্তু এতগুলো কথার অবতারণা যে কারণে, তা হলো হাইতির হতদরিদ্র মানুষদের ক্ষুন্নিবৃত্তির একমাত্র সহজলভ্য মাধ্যম - শক্ত এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরী এক ধরণের মাটির বিস্কুট, যা সেখানকার মানুষকদের কাছে অমৃতসম। মাটির বিস্কুট ! তাও কিনা খাবার ! অবাক লাগলেও এটাই ঘোর বাস্তব।
যা আদপে ডাইজেস্টিভ বিস্কুটের মতো দেখতে হলেও শক্ত এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরী এই বিস্কুট খেলে অন্তত ৫-৬ ঘন্টার জন্য নিষ্কৃতি। সেটা ছোট বড় সবার জন্যই। বাজারে এর চাহিদা মারাত্মক। হাইতির অর্থনীতি এতটা খারাপ যে বেশিরভাগ মানুষ দৈনিক ২ ডলারের চেয়ে কম রোজগার করে , যা দিয়ে স্বচ্ছল ভাবে জীবন চালানো অসম্ভব। তাই তাঁদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে এই মাটির বিস্কুট , যা স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারকও।
হাইতির সিটি সলেল বস্তিতে এর চাহিদা ও বাজার বেশি। মূলত অতি দরিদ্র , গর্ভবতী মহিলারা ক্যালসিয়ামের জন্য এই বিস্কুট খেলেও এখন সবাই খায়। এই বিস্কুট তৈরী হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। জল দিয়ে মাটি নরম করে তাতে মেশানো হয় লবন, ভোজ্য তেল, কিছু ধুলো , আবর্জনার অংশ , তারপর শোকানো হয় রোদে। শুকিয়ে গেলে বাজারে বিস্কুটের আকারেই বিক্রি হয় ক্রেতাদের কাছে।
কিন্তু স্বাস্থ্যের দিক থেকে বিষয়টি মারাত্মক ক্ষতিকারক চিকিৎসকদের কাছে। কারণ মাটি হেলমিথ নামক ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয় , যা অপুষ্টির অন্যতম সহায়ক। কিন্তু এহেন পরিস্থিতির কারণ কি?
২০০৭ জুন থেকে ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারী, এই সময়ে সারা বিশ্বে প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে খাদ্য মূল্য। হাইতির মতো দেশ যারা মূলত ভাত , রুটির উপর বেশি নির্ভরশীল, মূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাবে খাদ্য থাকলেও তার চড়া হার যোগান ও চাহিদাকে অপ্রতুল করে তুলেছে।
তেলের দামও এই পুরো বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত। পরিবহনে, সার তৈরিতে তেল লাগে, অর্থাৎ একটু বিশ্লেষণ করলে গোটা সিস্টেমটা চেইনের মতো তেল ভিত্তিক। তাও ১০ বছরে ১০শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে খরচ কমাতে আসে- বায়ো জ্বালানি, যা ভুট্টা থেকে তৈরী হয়, যার ব্যবসায়িক সাফল্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা গমের চাষ কমিয়ে দিয়ে ভুট্টার চাষ বাড়িয়ে দেয়। ফলে গমের কম সরবরাহ, বর্ধিত চাহিদার ফলে মূল্য বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায় এবং তারই পরিণতি মাটির বিস্কুট। যেখানে শুধুমাত্র প্রাণে বেঁচে থাকার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিস্কুট, সেখানে অপুষ্টির কথা ভাবা বিলাসিতা। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেও এটিই ক্ষুন্নিবৃত্তির সহজ ও একমাত্র উপায় হয়ে উঠেছেহাইতিবাসীদের কাছে।