আমরা যখন লিখি, তখন যদি হাতের কাছে পেনের জায়গায় পেনসিল থাকে, আমরা কিন্তু তখন পেনসিলকেই গুরুত্ব দিই(অবশ্য যদি না পেনে লেখা আবশ্যিক হয়)| কারণ, যেহেতু লেখার শুরু হয় আমাদের পেনসিল দিয়ে, তাই পেনসিলের প্রতি আমাদের একটা দুর্বলতা রয়েছেই| আর সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিমেদুর হয়ে যাই, ছোটবেলার লেখা নিয়ে| মনে পড়ে যায় পেনসিলের দুই মুখ কেটে নেওয়া, পেনসিলের এক মুখ কামড়ে কামড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলার ঘটনায়| যদিও আমাদের এই ব্যাপারটি করবার জো ছিলনা| মা তাহলে আর আস্ত রাখবেনা জানতাম| যে কোনো নোংরামি বাড়িতে ছিল নৈব নৈব চ| তাছাড়া মা-বাবার বক্তব্য ছিল, পেনসিল কামড়ালে বিদ্যা হবেনা| এই কারনে আমাদের ভাই-বোনের পেনসিল অর্ধেক ব্যবহার করে নষ্ট করারও উপায় ছিলনা| গোটাটা ব্যবহার হলে তবেই বাক্স থেকে নতুন পেনসিল বেরোত| বন্ধুদের দেখতাম, কি স্বাধীনতা এই ব্যাপারে-আর ভাবতাম, কি মজা ওদের|
এটা কিন্তু হয়| বাচ্চারা না বুঝেই পেনসিল নষ্ট করে| সেই কারনে অজান্তেই আমরা পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলি| প্রতি ১০০ কোটি পেনসিলের জন্য ১০ লক্ষ গাছ কাটা পড়ে| স্বাভাবিকভাবেই নতুন গাছ সেই পরিমানে রোপন করা হয়না| ভাবতে পারছেন? আমি, আপনি কেউই জানিনা সঠিক পরিসংখান, তো ছোটরা কিভাবে জানবে? তবে আজকে একটা আশার গল্প শোনাব আপনাদের| বেঙ্গালুরুর দম্পতি আকশাতা ভার্দ্রান্না এবং রাহুল পাগড অভিনব এক প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন| ‘ডোপোলজি’| যেখানে ইকো ফ্রেন্ডলি জিনিস তৈরী করেন তাঁরা| তার মধ্যে টুথব্রাশ, পেনসিল উল্লেখযোগ্য|
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, পেনসিল তৈরী করার ভাবনা এসেছিল ওই দম্পতির এভাবেই| পরিবেশ সংরক্ষণে তাই তাঁরা এগিয়ে এসেছেন| ‘ডোপোলজি’ তৈরির সঙ্কল্প নেওয়ার পাশাপাশি রাহুল নিজের মার্কেটিং-এর চাকরি ছেড়ে দেন এই কাজে আরো বেশি করে মনোনিবেশ করার জন্য| নিউজপেপার থেকে পেনসিল তৈরী করছেন ওই দম্পতি| যে পরিসংখ্যান-এর কথা জানালাম, তা যখন তাঁরা জানতে পারেন, তখনই সিদ্ধান্ত নেন, কিছু একটা করতে হবে| যেমন ভাবা তেমন কাজ| বৃক্ষক্ষয় রোধে তাঁরা নিজেদের নিয়োজিত করলেন| কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করে খবরের কাগজ থেকে তাঁরা পেনসিল তৈরী করেন|
প্রথমে ১৮x১৮ সেমি মাপে কাগজ কেটে নেন| পেনসিলের লিড অর্থাৎ সিস সেই টুকরো কাগজের সঙ্গে ম্যানুয়ালি রোল করে সেটা রোলিং মেশিনে দিয়ে দেওয়া হয়| মেশিনের কাজ হয়ে গেলে তৈরী হওয়া পেনসিল ৩০ মিনিটের জন্য প্রাকৃতিকভাবে শুকোনো হয়|
পেনসিল শুকিয়ে গেলে তা ২২০ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ঘন্টার জন্য ড্রায়ার-এ দেওয়া হয়|
এরপর পলিশিং মেশিনে পেনসিলগুলো মসৃণ করে তোলা হয়| এবারে কাটিং মেশিনে দিয়ে সাইজ মত কেটে নেওয়া হয়| গোটা পদ্ধতিটা যাতে ইকো ফ্রেন্ডলি হয়, তার জন্য প্যাকিং বাক্সও তাঁরা সমঝোতা না করে ইকো ফ্রেন্ডলি পেপার দিয়ে তৈরী করেন|
৬,০০০ নিউজ পেপার রিসাইকল করে তাঁরা ১০,০০০ পেনসিল তৈরী করেছেন এ পর্যন্ত|
এছাড়াও তাঁদের আরও একটি অভিনব কাজ রয়েছে| সিড পেপার(বীজ কাগজ) দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন রকম কার্ড তৈরী করেন| এছাড়াও ওয়েডিং কার্ড, ইনভিটেশন কার্ড, পোস্টকার্ড, ভিজিটিং কার্ড প্রভৃতিও তৈরী করেন| আকশাতা এবং রাহুলের এই কার্ডের খবর পেয়ে একটি বহুজাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে ১৫০ সিড কার্ড অর্ডার দিয়েছিল| সেই দিন ওই সংস্থার মহিলারা নিজেদের সবচেয়ে ভীতিকর এবং দুঃখজনক অভিজ্ঞতা ওই কার্ডে লিখে, তারপর তা ছিঁড়ে ফেলে গাছের বীজ রোপন করেছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাঁরা তাঁদের সেইসব খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসে অনেকটা স্বস্তি বোধ করেছিলেন| এইভাবে অনেকেই কিন্তু নিজেদের স্ট্রেস বা ডিপ্রেশন কাটাতে এই কার্ডের ব্যবহার করতে পারেন| তাহলে আবার নতুন করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরা যাবে|
ওই দম্পতি নিজেদের সামগ্রী মুম্বই, দিল্লি, পঞ্চকুলা, অমৃতসর-এ বিক্রি করেন| ওঁরা আরো বিভিন্ন স্টেশনারি জিনিসকে ইকো ফ্রেন্ডলিভাবে তৈরী করার কথা ভাবছেন| টেট্রা প্যাক থেকে শার্পনার তৈরির কথা ভাবছেন রাহুল এবং আকশাতা| আশা করব তাঁদের এই পরিকল্পনাও যেন বাস্তব রূপ পায়| সমাজের তথা পরিবেশের সংরক্ষণে আরও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করুন আপনারা|