বিশালতা, স্তব্ধতা, মৌনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পর্বতমালা। তেমনই এক পাহাড়ি জনপদ পাউরি। গাড়োয়ালের ছোট্ট অচেনা শহর পাউরি। শহরের শব্দ যন্ত্রনায় মন আর কান বাঁচাতে কিছু মানুষের কাছে অব্যর্থ দাওয়াই পাহাড়। দুদিনের জন্য শান্তি স্বস্তির জন্যই মানুষ ছুটে যায় পাহাড়ে। প্রকৃতির কাছে গিয়ে মনের শান্তির সন্ধান করতে অগণিত ভ্রমনার্থীর ভ্রমণ তালিকায় স্থান পেয়েছে পাহাড়।
ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে রয়েছে সৌন্দর্য্যের খনি। বিশেষত গাড়োয়াল এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। আবার পুণ্যার্থীর কাছেও পুণ্যধামের আঁতুড়ঘর গাড়োয়াল। গাড়োয়ালের ছোট্ট শহর পাউরি কিন্তু রূপ রস গন্ধ নিয়ে অনন্য।
দু’ভাবে যাওয়া যায় পাউরি। মুসৌরি হয়ে ধনৌলটি, এরপরেই পাউরি। আবার হরিদ্বার থেকে কোটদ্বার, ল্যান্সডাউন, খিরসু এরপর পাউরি। আমরা যেহেতু ধনৌলটি গিয়েছিলাম তাই ভ্রমণ যাত্রা সেপথেই অব্যাহত রেখেছিলাম। তাই গাড়ি এগিয়ে চলেছে সেই পথেই।
মুসৌরি চাম্বা রোড ধরে গাড়ি চাম্বার দিকে এগিয়ে চলল। পথে নতুন হিল স্টেশন কানাতাল। থাকা যেতে পারে। তবে আমরা এগিয়ে চলেছি পাউরির পথে।
পৌরি বা পাউরি একসময় ব্রিটিশ গাড়োয়ালের জেলা সদর ছিল। হিমালয়ের তিনটি গিরি শিরার উপর পাউরির অবস্থান। চারিদিকে ওক , পাইন , দেওদার , রোডোডেনড্রোন গাছে ছাওয়া। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আমরা পথে চাম্বা জেলায় রোডোডেনড্রোনের শরবত একটু চেখে নিলাম। চাইলে নিয়ে ও আসা যায়। অকৃত্রিম রোডোডেনড্রোনের শরবত পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর পানীয়র স্বাদ পাওয়া বাড়তি পাওনা।
পাইন, ফার, ওক, দেওদার, রোডোডেনড্রোন গাছে ঘেরা কন্ডোলিয়া পাহাড়ের শিরোভাগে রয়েছে পাউরি। পাহাড়ের তলদেশ পর্যন্ত খাড়াই ঢালে আল্পনার মতো চাষক্ষেত, ঘন সবুজ বনাঞ্চল, ঝরঝর করে বয়ে চলা ঝর্ণার কলধ্বনি, পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম, গ্রামের ঘরের ছোট্ট ছোট্ট গবাক্ষ, ঝুলানো বারান্দা আর সর্পিল গতিতে আঁকাবাঁকা পথের সারি সব মিলিয়ে পাউরি যেন পটে আঁকা ছবির মতো গ্রাম।
পাউরি শহরের মূল আকর্ষণ হলো দিগন্তরেখা বরাবর শ্বেতশুভ্র কিশোরধবল পর্বতমালারাজি। শহরের যে কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় পূবাকাশে হেলানো কেদারনাথ শৃঙ্গ আর নন্দাদেবী কখনও সোনার মুকুট কখনো বা রুপার মুকুট পরে দন্ডায়মান। এছাড়া বান্দরপুঁছ, স্বর্গারোহিনী, গঙ্গোত্রী, যোগিন, সুমেরু, হাতিপর্বত, সতোপন্থ, নীলকন্ঠ, গৌরীপর্বত, ত্রিশূল পর্বত দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডোলিয়া পাহাড় থেকে মনে হয় হাত বাড়ালেই শৃঙ্গ ছোঁয়া যাবে।
এত রূপ নিয়েও পাউরি কিন্তু হিল স্টেশনের মর্যাদা পায় না। কেন জানি না তীর্থযাত্রী বা পর্যটকদের কাছে পাউরি আজও ব্রাত্য। তিনটি মনোরম উদ্যান, খেলার মাঠ, পাবলিক লাইব্রেরি, বাস স্ট্যান্ড-এ লক্ষী নারায়ণের মন্দির, ঘন জঙ্গলে কন্ডোলিয়া শিব মন্দির , নাগদেবতা মন্দির , মসজিদ , চার্চ , কংকালেশ্বর শিব মন্দির সবই এখানকার দ্রষ্টব্যস্থল।
থাকার জন্য রয়েছে গাড়োয়াল বিকাশ মন্ডল নিগমের রেস্ট হাউস। G .M.V.N বাংলোয় থাকার খরচ এখানে সাধ্যের মধ্যেই। খাওয়া দাওয়া স্থানীয় শৈলীতেই তৈরি। একদিনের জন্য এখানে বিশ্রাম করে পরেরদিন সূর্যোদয় দেখে ব্রেকফাস্ট করে এগিয়ে চললাম আমরা শৈলরানী খিরসুর উদ্যেশ্যে।
ছোট্ট শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ মন সেখানেই স্থায়ী আস্তানা গড়ে তুলতে চায় কিন্তু শহুরে মানুষের জীবনে যেখানে শুধুই গতি সেখানে আস্তানা গড়ে তোলার স্বপ্ন শুধুই অলীক কল্পনা। তাই কল্পনা স্থান পায় মনজগতে। আমরাও তাই এগিয়ে চলেছি আরো এগিয়ে। জীবনের ধর্মই যেখানে চরৈবতী সেখানে আমরা তো সাধারণ মানুষ।
শুধু পিছনে পড়ে থাকে পাহাড়ি গ্রাম্য সরল মানুষগুলোর আন্তরিক মায়ার চাদরে মোড়া আপ্যায়নের স্মৃতি আর দিক দিগন্ত মুড়ে রাখা হিমালয়ের শ্বেত শুভ্র তাজ, সুবজ শ্যামল ক্যানভাস, রং ধনু রঙের কোলাজ।