পাথুরিয়াঘাটা। ২৬ প্রসন্ন কুমার স্ট্রিট। উত্তর কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলের হাজার এক ভিড়ের মধ্যেও চোখ টেনে নেবে এক আধভাঙ্গা ক্ষয়াটে চেহারায় অন্যরকম বাড়ি। বাড়ি তো নয়, যেন রূপকথার গল্পে, ছবিতে দেখা আস্ত এক কেল্লা যেন। ভাঙ্গা ইটের এবড়োখেবড়ো দেওয়ালেও বিলাতী ছাপ স্পষ্ট।
শুধু দর্শনে কেল্লা নয়, নামটিও সেভাবেই পরিচিতি পেয়েছিল। টেগোর ক্যাসেল। এই বাড়িকে একসময় কলকাতা একনামে চিনত। শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্পকলার তীর্থ ভূমি। কেল্লায় থাকতেন এক মহারাজা। তিনি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। মহারানী ভিক্টোরিয়া তাঁকে খেতাব দিয়েছিলেন।
দিলদরিয়া স্বভাবের মহারাজা বাহাদুর যতীন্দ্রমোহন সমস্ত ক্ষেত্রে নিজস্বতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের নক্ষত্র ছিলেন। নিজের বসতবাটিও ব্যতিক্রম নয়।
১৮৫৪ সালে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর পারিবারিক উত্তোরাধিকার সূত্রে একটি বসত বাড়ি পান। পরে সেই বাড়িকেই দিয়েছিলেন দুর্গের চেহারা । তার ফল হিসেবেই উত্তর কলকাতার বুকে গড়ে ওঠে ইংল্যান্ডের উইন্ডসর কাসল। তার আদলেই বদলে যায় পুরনো বাড়ির খোলনলচে। বাড়ির প্ল্যান করেছিল ম্যাকিনটশ বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। সব দিক থেকে অন্যরকম। বাড়িটিতে ১০০ ফুট উঁচু একটি মিনার তৈরি করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিগবেনের মতো একটি ঘড়িও ছিল যতীন ঠাকুরের কেল্লায়। ইংল্যান্ড থেকে আনানো হয়েছিল। এমনি মিলেছিল ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক লাগাবার অনুমতিও ।
বঙ্গ ইতিহাসে এই বাড়ির স্থান অতি গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত এই বাড়িতেই ছিল ‘বঙ্গ নাট্যালয়’। ‘মালবিকাস্তোত্রম’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যতীন্দ্র মোহন ও তাঁর ভাই সুরেন্দ্র মোহন ঠাকুর।
যতীন্দ্রমোহনকে ‘মহারাজ-বাহাদুর’ বলা হত সে সময়। পেয়েছিলেন ‘স্যার’ খেতাব। শিল্পকলা এবং সাহিত্যের বহুক্ষেত্রে নিজস্ব ছাপ রেখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনিই। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ছিলেন।বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। প্রকৃত অর্থে সঙ্গীতমোদি মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। অনেক গুণী সঙ্গীত প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তবে শুধু মাত্র বিশেষ কোনও একটা ক্ষেত্র দিয়ে তাঁর অবদানের ব্যাপ্তি বোঝা সম্ভব নয়।
১৯৫৪ সালে এস. বি. হাউস অ্যান্ড ল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেডের হরিদাস মুন্দ্রা এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। তারপরে অনেকটাই বদলে যায় কেল্লার চেহারা। পরবর্তী সময়ে জবর দখল আর আইনি সমস্যায় জেরবার। কালের থাবায় জর্জর দশা। দেখে বোঝার এতটুকু উপায় নেই অতীতের জাঁক।
উত্তর কলকাতার বুকে হারিয়ে যাওয়া গৌরবের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে টেগোর ক্যাসেল। তবে হঠাৎ দেখে কোনওভাবেই চেনার উপায় নেই।