হাঁটু ছুঁই ছুঁই খাটো ধুতি। পরণে মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটে নিজে হাতে কাচা। ইস্ত্রির নামমাত্র নেই। সঙ্গী বলতে এক হাতে একটা লণ্ঠন আর অন্য হাতে লাঠি। এই নিয়েই প্রতিদিন মাঠঘাট বেরিয়ে ভাগলপুরের উপেন গাঙ্গুলীর সন্ধ্যের আড্ডায় আসত এক যুবক।
ভরা সভার মাঝে সবাই যখন কথা বলত সে তখন শুনে যেত খালি। যুবক আড্ডায় আসেন, যান। তার পরিচয়ও বাকিদের কাছে খুব একটা জানা নেই।
ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় ‘উপেন গাঙ্গুলীর বাড়ি’ তখন আশেপাশে সাহিত্য-রসিক মানুষদের কাছে এক অমোঘ টান। সেই বাঙালিটোলাতেই বিখ্যাত গাঙ্গুলিবাড়ি সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামারবাড়ি। সেই বাড়িতেই জীবনের প্রথমার্ধ কেটেছিল তাঁর। সেই বাড়িরই আর বিখ্যাত পুরুষ উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
ওকালতি করতে ভাগলপুর এসেছিলেন, কিন্তু লেখা আর সাহিত্য যাঁর নেশা তাঁর দুনিয়া কীভাবে বন্দী হবে কোর্ট রুমের চারদেওয়ালে। সেই নিয়তিতেই উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বিচিত্রা সম্পাদক।
যাইহোক, একদিনের ঘটনা বলি।
তখন ভাগলপুরে ভরা গ্রীষ্ম। প্রচন্ড গরম। দিনে রোদের তাতে বেরনোর জো নেই। বিকেলে কালবৈশাখী দু দন্ড স্বস্তি দেয়।
কোর্টে গ্রীষ্মাবকাশ চলছে। উপেন বাবুর হাতে বেশ খানিকটা সময়। শুরু করলেন নতুন উপন্যাস। ঝড় বৃষ্টির জেরে সন্ধ্যের আড্ডাও তেমন জমে না। সারাদিন লেখার পর উপেনবাবু মুখিয়ে থাকেন সন্ধ্যের আড্ডার জন্য। সেদিন হল কী, ঝড় জলের চোটে বৈঠকখানা ঘরে আর আড্ডার জন্য আর কেউ এলো না। সঙ্গীহীন গাঙ্গুলীমশাইয়ের মন বেজায় খারাপ।
বৃষ্টির দাপট একটু কমতে দরজা-জানলাটা খুললেন। বাইরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন বেশ কিছুটা দূর থেকে যেন এক লন্ঠনের আলো তাঁর বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। আলো আর একটু কাছে আসতে দেখলেন ছায়ামূর্তি। বুঝলেন তাঁর বাড়িতেই সে আসছে। মনে মনে বেশ খুশি হলেন। যাক! সন্ধ্যেটা একেবারে শুকনো কাটবে না!
ঘরের আলোয় সেই ছায়া প্রবেশ করতেই অবশ্য খানিকটা দমে গেলেন। এ সেই মুখচোরা যুবক। এতদিন আড্ডায় এসেও যে একটা বারের জন্য নিজের নাম-সাকিন বলতেও মুখ খোলেনি, সাহিত্যরস-আড্ডা তো অনেক দূরের ব্যপার!
যুবক ঘরে ঢুকতে, সামনে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন উপেন বাবু। উত্তরে সে অত্যন্ত লাজুক গলায় বলল, ‘আরও অনেকেই আসবেন, ওঁদের জায়গায় আমার বসাটা কি ঠিক হবে?’
উপেন বাবু জানালেন সেদিন আর কেউ আসবে না। সেদিন বেশ কয়েকটা কথার পর তিনি জানতে পেরেছিলেন যুবকের নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে পেটের দায়ে ভাগলপুরে এসেছেন। ভাগলপুরের খেলাত ঘোষেদের জমিদারি সেরেস্তায় নায়েবে।
শ্বাপদ সংকুল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন মাইল দু-তিন পথ পেরিয়ে যুবক আড্ডায় আসেন।
যুবকের কথা শুনতে শুনতে চমকে যান তিনি। জঙ্গলে যুবকের ভয় করে না। এই পথ সে ভালোবাসে। অরণ্যের ছায়া ঘেরা একলা পথ তাকে বড় মায়ায় টানে। হাতে একটা লাঠি থাকে বটে, কিন্তু সাপ খোপে তার খুব ভয় নেই।
বাঙালিটোলার এই গাঙ্গুলীবাড়িকে তীর্থক্ষেত্র মানতেন যুবক বিভূতিভূষণ। শরৎচন্দ্র, অনুরূপা দেবী আরও বহু বিখ্যাত সাহিত্যিকের স্মৃতি মিশে আছে বাড়িতে তাই এ বাড়ি তাঁর কাছে তীর্থ সমান।
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তখনও ‘বিচিত্রা সম্পাদক’ হয়ে ওঠেননি। বিচিত্রা তখনও তাঁর মনের মধ্যে ভ্রুণ নিদ্রায়। তিনি যেন আবিষ্কার করলেন একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া বিভূতিভূষণকে। অরণ্যভূমির নির্জনে নিজের মধ্যে তাঁর বাস। মুখচোরা লাজুক মানুষ। বুকের মধ্যে কথা জমে, মুখ ফোটে না। নিশ্চয়ই কিছু লেখেন যুবক- এই কৌতুহলে উপেনবাবু তাঁকে খানিকটা উস্কে দেন।
কথায় কথায় ততক্ষণে বেশ কিছুটা সহজ হয়েছেন বিভূতিভূষণ। বিচিত্রা সম্পদককে জানালেন, তিনি একখানা উপন্যাস লিখেছেন।
‘উপন্যাস? আ-আপনি লিখে ফেলেছেন?’
শুনে এক্কেবারে হাঁ! বিভূতিভূষণের দিকে বিস্ময়ে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে রইলেন!
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ। কোথায় কখনও লেখা বের হয়নি, পত্রিকায় প্রকাশ নেই। কবিতা পর্যন্ত লেখেনি, এমন মানুষ একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলেছে এই ব্যাপারটিই ঠিক হজম করতে পারছিলেন না যেন তিনি। তাঁর কাছে কান্ডটি সাংঘাতিক!
সেদিন বিভূতিভূষণ জানিয়েছিলেন, ‘অনেকদিন ধরেই ভিত্তর ভিতর একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম আমাদের দেশের কথা, আমার গ্রামের কথা উপন্যাস আকারে লিখে যাব। গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারি করতাম অবসর ছিল, তাই লিখে ফেলেছি।’
তিনি লেখেন ছোট-ছোট অক্ষরে। তাতেই চারশো পাতা লিখে ফেলেছেন।
উপেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন উপন্যাসের অঙ্ক, পরিচ্ছেদ কত? কঅন পরিচ্ছেদে কত শব্দ আছে? সে সম্বন্ধে বিভূতিভূষণ বিশেষ বলতে পারলেন না। তিনি লিখেছনে প্রাণের আনন্দে। লেখায় যে অঙ্কের হিসেবও আসতে পারে- এ তাঁর আন্দাজ ছিল না। লেখায় হিসেবের কথা শুনে বেশ দমে গিয়েছিলেন।
উপেন্দ্রনাথ সে কথা আন্দাজ করতে পেরে অভয় দিয়েছিলেন। তিনি দেখতে চান বিভূতিভূষণের পান্ডুলিপি।
সে রাতে আর বিভূতিভূষণের চোখে ঘুম এলো না। শুধু গুনে চলেছেন পরিচ্ছেদের শব্দ। এক পরিচ্ছেদের সঙ্গে আর এক পরিচ্ছেদ কিছুতেই মেলে না। শেষ রাত অবধি চলল। ভোরের দিকে ঘুম জড়িয়ে এলো চোখে।
পরদিন কোনও রকমে দিনের কাজ শেষ করে দুপুর গড়াতেই খাতার তোড়া নিয়ে ছুটলেন উপেনবাবুর বাসায়।
তাঁকে জানালেন, সারারাত ধরে গুনেছেন, কিচ্ছু মেলেনি। স্তব্ধ উপেনবাবু বললেন, ‘খাতাগুলো তিনি একবার পড়ে দেখতে চান।’
খাতা তাঁর কাছে রেখে এলেন বিভূতিভূষণ।
মাস দুয়েক কেটে গেল কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিভূতিভূষণও লেখা নিয়ে কোনও কথা জিজ্ঞেস করেন না। একদিন উপেন্দ্রনাথ নিজেই আড্ডা শেষে ডাঁড়াতে বললেন। বিভূতিভূষণ উৎকণ্ঠায়।
উপেনবাবু জানালেন, ‘খাতাগুলো তিনি পড়েছেন’।
সাড় এলো যেন বিভূতিভূষণের শরীরে। জীবনে এত খুশি কমই পেয়েছেন। তবে সেই ভাব যত সম্ভব চেপে রেখেই ফের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অঙ্ক’?
‘অঙ্কে বেশ কিছু গরমিল অবশ্য আছে…’
কিন্তু অঙ্ক দিয়ে কি সব কিছু বিচার করা যায়, ব্যতিক্রম তো থাকবেই। তরুণ বিভূতির সেই উপন্যাসকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ।
‘বনবাসী’ বিভূতির উপন্যাসের ভার তিনি নিজে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েকমাসের ঘটনাক্রম ভারি অন্যরকম। সাহিত্যলক্ষ্মী যেন নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন সেই নিয়তির পথ।
ভাগলপুরের বাস তুলে কলকাতা চলে এলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কয়েকমাস পরেই সাহিত্যক্ষেত্রে রাজ সমারোহে আবির্ভাব ঘটল ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার। ২৭/১ ফড়িয়া পুকুর স্ট্রিটে তার দফতর।
গোটা কলকাতার দেওয়াল ভরে গেল বিচিত্রার পোস্টারে। সে এক এলাহী ব্যাপার। শহরে হইচই। এদিকে ভাগলপুরে বস৪এ বিভূতিভূষণ কিন্তু তার কিছুই জানতে পারলেন না। তাঁর সম্বল শুধু দিন গোনা।
একদিন কোনও উপলক্ষে কলকাতায় এলেন বিভূতিভূষণ। ঠিক করলেন উপেনবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করবেন। সাত পাঁচ ভেবে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে গেলেন ফড়িয়াপুকুরে বিচিত্রার দফতরে।
ঘরে তখন জনা পাঁচেক সুসজ্জিত ভদ্রলোক। চায়ের কাপে, সিগারেটের ধোঁয়ায় ঢাকা ঘরে জোর তর্ক চলছে সাহিত্য নিয়ে।
আধময়লা ধুতি আর চটির থলি হাতে আগন্তুক যেন বড় বেমানান। সে ঘরের মানুষজনও খুব একটা পাত্তা দিলেন না। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, ‘কী চান এখানে? আপনি কি এজেন্ট?’
আমি এজেন্ট নই।
‘তবে কি লেখক? কবিতা লিখেছেন...’
উত্তর এলো, ‘ আমি লেখকও নই, কবিতা দিতেও আসিনি’।
আগন্তুক জানালেন তিনি ‘পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চান’
জানা গেল তিনি এখনও আসেননি। তাঁর যা দরকার তা যেন দফতরে বলে যান।
দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছেন বিভূতিভূষণ। এমন সময় উপেন গঙ্গোপাধ্যায় এলেন। প্রায় জড়িয়ে ধরে ঘরে এনে বসালেন সোফায়। ঠিক সেই ভদ্রলোকের পাশে, যিনি খানিক আগেই বিভূতিকে এজেন্ট ভেবে পত্রিকার দর শুনিয়েছিলেন।
ভাগলপুরের খবর আর কুশল সংবাদের পর উপেন্দ্রনাথ বিভূতিকে জানালেন, ‘আগামী সংখ্যা থেকেই আপনার উপন্যাস বেরোচ্ছে...’
চুপ করে গেল গোটা ঘর। অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে লেখকের দিকে। খানিক আগেই যাকে দরজা থেকেই বিদায় করতে চেয়েছিল যারা।
বিভূতিভূষণ আর দাঁড়াননি। মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছিলেন দফতর থেকে। কলকাতা তাঁর কোনওদিন পছন্দের ছিল না, কিন্তু সেদিন ফেরার পথে একটু একটু যেন ভালবাসতে শুরু করেছিলেন শহরটাকে।
পরের মাস থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস বেরতে শুরু করল বিচিত্রায়। সন ১৩৩৫। আষাঢ় সংখ্যা। ্নাম ‘পথের পাঁচালি’।
উপন্যাস সাড়া ফেলে দিয়েছিল পাঠক সমাজে। ইছামতীর নদী তীরে এক চরভূমিতে জীবনের াখ্যান। নিম্নবিত্ত পরিবারের সুখ দুঃখের গল্প কীভাবে যেন এক জাতির জীবন্ত দলিল হয়ে উঠল, তাই নিয়েই পথের পাঁচালির চলন। প্রকৃতি উতলরূপে ধরা দিয়েছে উপন্যাসে।
গোটা শহরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল ‘কে এই লেখক’।
উপন্যাস বিচিত্রা প্রকাশিত হতে শুরু করলে হঠাৎ একদিন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করতে এলেন বিভূতিভূষণের কাছে। নব্বইটা টাকা দিলেন বিভূতিভূষণের হাতে। ‘পথের পাঁচালি’ তিনি ছাপতে চান।
ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে গেলেন বিভূতিভূষণ!