"মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে জীবন হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।''....
কোন মহামানবের রচিত কবিতার অংশ এটি তা আমরা সব্বাই জানি। তাঁর জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ , তাঁর বংশ পরিচয়, ১৯১৩তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি , গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি, তাঁর লেখা গান কবিতা, গল্প, নাটক, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, চিঠি নিয়ে তিনিই যে একটি প্রতিষ্ঠান .... এই তথ্যগুলো মোটামুটি নিরানব্বই শতাংশ বাঙালির জানা। তিনিই যে পৃথিবীর একমাত্র লেখক/কবি যিনি দুটো দেশের (ভারত এবং বাংলাদেশ) জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা এটাও মোটামুটি সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। তিনি যে কবিগুরু, বিশ্বকবি, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী তাঁকে প্রথম "গুরুদেব" সম্বোধন করেছিলেন.. এইকথাও ভারতবাসী মাত্রেরই জানা। বস্তুতঃ তাঁর নামটি আমরা বাঙালিরা একেবারে শৈশবে যখন প্রথম কথা বলতে শিখি, তখন থেকেই জানি। আমাদের প্রত্যেকটা প্রশ্বাসে জড়িয়ে তাঁর নাম। বাংলার তথা ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইকন তিনি... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সারা বিশ্বের কাছে আমাদের পরিচয় আমরা "টেগোর" এর দেশের মানুষ।
তিনি অমর। যতোদিন পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রজাতিটির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের ভাবনায়, ভাষায়, কথায়, কবিতায়, গানে, শিক্ষায়, বিদ্যায়, রুচিতে, আমাদের আনন্দে, বেদনায়, আমাদের কাজে, আমাদের রক্তধারায়, আমাদের হৃদয়ে। আমাদের চরম আনন্দের মুহূর্তে ও তিনি আমাদের পাশে...
"আনন্দধারা বহিছে ভুবনে.. দিন রজনী কতো অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে"...
আবার যখন দুঃখে বেদনায় আমরা দুমড়ে মুচড়ে যাই তখনও তিনিই.....
"সহায় মোর না যদি জুটে
নিজের বল না যেন টুটে
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়"...
নিজের মনকে দৃঢ়, কলুষহীন করার
পথ ও তাঁরই দেখানো....
"নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথা দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ্বপানে
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো এ জীবন পুণ্য করো এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে"...
কিন্তু তিনি ও তো আমাদের মতো একজন মানুষই ছিলেন। তাই তাকে ও এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন বিদায় নিতে হয়েছিল। আর সেই চরম দুঃখের দিনটি ছিল বাইশে শ্রাবণ। আজ সেই সময়টা নিয়েই একটু লিখি?
মৃত্যুকে তিনি কখনো ভয় করেন নি। জীবনের মধ্যে থেকেই তিনি বারবার দুঃখকে আর মৃত্যুকে সহজে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন বা করেছিলেন।
উপনিষদ থেকে তাঁরই ভাবানুবাদ করা শ্লোক.... ‘‘শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ/ দিব্যধামবাসী। আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি/ আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়।/ তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি/ মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।’’
১৯৩৯ সালে তিনি বলছেন.....
"যদি মৃত্যুর পূর্বে হাসিমুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করবো না।’’
মংপুতে একবার মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’' (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ– মৈত্রেয়ী দেবী)
"মংপুতে রবীন্দ্রনাথ" গ্ৰন্থে তিনি আবারও বলছেন.. "আমি কোনো দেবতা সৃষ্টি করে প্রার্থনা করতে পারি নে। নিজের কাছ থেকে নিজের যে মুক্তি – সেই দুর্লভ মুক্তির জন্য চেষ্টা করি। সে চেষ্টা প্রত্যহ করতে হয়। তা না হলে আবিল হয়ে ওঠে দিন। আর তো সময় নেই। যাবার আগে সেই বড়ো আমিকেই প্রধান করে তুলতে হবে। সেইটেই আমার সাধনা"....
কেমন ছিল সেই দিনটি ? তার বর্ণনা সবথেকে সুন্দর ভাবে পাই বুদ্ধদেব বসুর লেখায়... একটু তুলে দিই সেখান থেকে...
........" তার ক্ষুধাবোধ একটুও ছিলোনা, ক্লান্তিও না, আর কোনো চেতনাই তার ছিলোনা দুঃখের চেতনা ছাড়া, মহৎ, মহামূল্য, তুলনাহীন দুঃখ, কল্পনায় চেনা, সম্ভাবনায় পুরনো, তবু বাস্তবে আশ্চর্য, আকস্মিকের মতো নতুন, অবিশ্বাস্যের মতো অসহ্য। … সকালে গিয়ে যেই বুঝলো যে আজই শেষ, তখনই স্থির করলো শেষ পর্যন্ত থাকবে, তারপর কেমন করে কাটলো ঘন্টার পর ঘন্টা, ভিড় বাড়লো, জোড়াসাঁকোর বড়ো-বড়ো ঘর আর বারান্দা ভরে গেলো, উঠোনে আরো -, টেলিফোনে বসে গেঞ্জি গায়ে কে-একজন ঘামতে-ঘামতে খবর জানাচ্ছে চেঁচিয়ে, তাছাড়া চুপ, অত লোকের মধ্যে কারো মুখেই কথা নেই, চেনাশোনারা পরস্পরকে দেখতে পেয়ে কিছু বলছে না, নতুন যারা আসছে তারা কিছু জিগেস না-করেই বুঝে নিচ্ছে। অপেক্ষা, বোবা অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা – কিসের? … একবার, অনেকক্ষণ পর, একটু বসে ছিলো সে, বসে থাকতে-থাকতে হঠাত একটা শব্দ শুনলো – পাশের ঘর থেকে – অনেকক্ষণ চেপে রাখার পর বুকফাটা ঝাপ্টা দিয়েই থেমে যাবার মতো, আর সঙ্গে-সঙ্গে অনেকেই তাকালো হাতের, দেয়ালের ঘড়ির দিকে, বারোটা বেজে কত মিনিট কী-যেন ফিশফিশানি উঠলো। খানিক পরে যখন একবার করে ঘরে যাবার অনুমতি দিলো সবাইকে – সেও গেলো। মাথাটি মনে হলো আগের চেয়েও বড়ো, প্রকান্ড, কিন্তু শরীরটি একটু-যেন ছোট হয়ে গেছে, যদিও তেমনি চওড়া কব্জির হাড়, তেমনি জোরালো, প্রচন্ড আঙুল। শেষবার সে চোখ রাখলো তার কতকালের চেনা সেই মুখের, মাথার, কপালের দিকে, মহিমার দিকে, একবার হাত রাখলো হিমঠান্ডা পায়ে। … আর সেই মুহূর্তটি যেই মনে পড়লো সত্যেনের, যেই দেখতে পেলো মনের চোখে আবার সেই প্রকান্ড মাথার ক্লান্ত নুয়ে পড়া, অমনি তার বুক ঠেলে একটা গরম শিরশিরানি উঠলো, মুখ ফিরিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি।....(তিথিডোর, বুদ্ধদেব বসু)
১৯৪১ এর আগস্টের প্রথম দিন... দুপুরবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। বারবার জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর। আগস্টের ৩ তারিখ থেকে কিডনিও আর কাজ করছিল না। ৬ আগস্ট রাখি পূর্ণিমার দিন কবিকে পূর্বদিকে মাথা করে শোয়ানো হল। পরদিন ২২শে শ্রাবণ,১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, (১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগস্ট) সকাল দশটা... রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মন্ত্র জপ করা হয় ব্রাহ্ম মন্ত্র ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম..’ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়.....’। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। আলোয় ভেসে রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন অমৃত আলোকের নতুন দেশে।
.."আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা/ আলো নয়ন-ধোওয়া আমার আলো হৃদয়-হরা"...