কলকাতার অগ্নিদেবের মন্দির

এক আগুনে মন্দিরের গল্প। মেটাকাফ লেনে আজও রয়েছে পার্সি উপাসনাস্থল। বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্রে তিলোত্তমা, মন্দির, মসজিদ গির্জা, সিনাগগ নিয়ে নিজের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৌবাজারের ট্রাম লাইন ধারেই চশমার দোকানের গলি ধরে এগিয়ে যাওয়া। খানিক এগিয়েই বাঁক নিতে হবে। ঘুরপথে লালবাজারের উল্টো দিকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট লাগোয়া গ্র্যান্ট লেন ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে এই শহরের ঐতিহ্যের। 
 
তবে সবচেয়ে ভাল হয়, মিশন রো অর্থাৎ গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের সাবেক চিনে রেস্তোরাঁর উল্টো দিকের গলিটা ধরলে, সে রাস্তাই আপনাকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কলকাতায় নিয়ে আসবে। নানান ধর্মের সহাবস্থানের এক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরবে। টাইম মেশিনে সওয়ার হয়েই পুরোনো কলকাতায় পাড়ি। এ পাড়ায় এলে অন্য যুগে ডুব দেওয়া নিশ্চিত। গণেশ অ্যাভিনিউ লাগোয়া ঘিঞ্জি নোংরা গলিপথটাই মেটকাফ স্ট্রিট। আঁকাবাঁকা পথে পেরিয়ে শেষে বৌবাজারের ট্রাম রাস্তায় মিশেছে মেটাকাফ স্ট্রিট।
 
একেবারে শেষ প্রান্তে পার্সি মন্দির বা এ পাড়ার লোকেদের ভাষায় সেটাই পার্সি গির্জা। ৯১ নম্বর মেটকাফ স্ট্রিটে জরাথ্রুষ্টবাদীদের উপাস্য অগ্নিদেবতা সদা জাগ্রত। কিন্তু এ তল্লাটে মন্দির থাকলেও দিনভর ভক্তসমাগম হয় না। আগস্টে পার্সিদের নববর্ষ, মার্চের বসন্ত উৎসবে সামান্য ভিড় হয় এই যা। বিক্ষিপ্ত পারিবারিক আচারে আজও মন্দিরে আসে শহরের পার্সিরা। একসময় মহানগরে প্রচুর পার্সি থাকলেও, হাল আমলে সংখ্যাটা নেহাতই কম। এই মন্দিরের নিয়মিত কিছু ভক্ত ছাড়াও মন্দিরের অছি পদে নিযুক্ত রয়েছে গুটিকয়েক কর্মী। পার্সিদের পূজারী বিশেষ ধরনের টুপিধারী মোবেড বা দস্তুরদের দেখা মিলবে মন্দিরে।
 
সাদা ধবধবে প্রাসাদোপম পেল্লাই বাড়ি দেখে চমকে যেতে পারেন। বাহারি লোহার গেট, সে নাড়ানোও যে সে লোকের কম্ম নয়। এমনিতে গেট বন্ধই থাকে। মন্দিরের ভিতরের ঝকঝকে উঠোন। বোঝাই যায় শতবর্ষের গণ্ডি পেরোনো মন্দিরের বাহার কম নয়। কলকাতার কয়েকশো পার্সির শিবরাত্রির সলতে এই মন্দিরটি, তাই তার নিত্য যত্নেরও অভাব হয় না। একতলার উঠোনে প্রহরী, এক শতকের কলকাতার সাক্ষী বিলিতি ঠাকুরদা ঘড়ি ও দেওয়ালে খোদাই লম্বা দাড়ি, ডানামেলা জোব্বাধারী এক বুড়ো সবচেয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে এক জম্পেশ আয়োজন।
 
ওই জোব্বাধারী বৃদ্ধই পার্সি ধর্মের 'গার্ডিয়ান এঞ্জেল'। তাঁর নাম, ফারাহভার। মুম্বই থেকে চার বছর আগে কলকাতায় বদলি হয়ে আসেন মন্দিরের সেজ পূজারী এরভাড ব্যায়রাম কারনজিয়া। পার্সিদের প্রায় সক্কলের গলার মাদুলিতে ডানামেলা বুড়োর ছোঁয়া। তাঁর ডানার খোপকাটা তিন ভাগে পার্সি ধর্মের মূল সুর। যা ভাল ভাবা, ভাল বলা, ভাল করার প্রতীক। যিশুর দেড়-দু-হাজার বছর আগের সুপ্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি এভাবেই মিশেছে কলকাতার মন্দিরে।
 
সেই ১৯১২ থেকে দোতলায় উপাসনা কক্ষে অক্লান্তভাবে জ্বলে চলেছে অগ্নিকুণ্ড। আগুনের সামনে অবশ্য ভিনধর্মী কারও যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে বাইরে ঘষা কাচের অপরূপ নকশার বাইরে থেকে সে দৃশ্য চোখে পড়লে জুড়িয়ে যায়। রঙিন ঘষা কাচেই দৃশ্যমান সৃষ্টিকর্তা আহুরা মাজদা, প্রফেট জরাথ্রুষ্ট, পশুপাখি, উদ্ভিদকুল, আকাশ, মাটি ইত্যাদির প্রতিনিধি এক একটি দিব্যমূর্তি। মুম্বইয়ে গোটা ৫০ অগ্নিদেবতার মন্দির থাকলেও, কলকাতায় মাত্র একটিই আগুনের মন্দির রয়েছে।
 
একদা পশ্চিম ভারত থেকে কলকাতায় ভাগ্যের খোঁজে ছুটে এসেছিলেন পার্সিরা। কলকাতার আগত পার্সিদের এক সময়ে 'বেঙ্গলি' পদবী নেওয়া রেওয়াজ ছিল। মেটাকাফ স্ট্রিটের এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ধুনজীভাই বেহরামজী মেটা ও তস্যপুত্র রুস্তমজী ধুনজীভাই বেহরামজী মেটা উনিশ শতক ও বিশ শতকের গোড়ার দিকের কলকাতায় এসেছিলেন। তারা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবার। তাদের হাতেই এই মন্দিরের সৃষ্টি। এর আগে অবশ্য এজরা স্ট্রিটে ছোটখাটো অস্থায়ী এক অগ্নিদেবতার মন্দির ছিল।
 
মেটকাফ স্ট্রিটের এই অংশে মিলেছে ধর্ম। এক হয়ে গিয়েছে ঈশ্বর। যেন একেশ্বরবাদের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। পার্সি মন্দির, শিয়া ইস্মাইলি মুসলিমদের জামাতখানা ও আবছা চিনে অক্ষর সর্বস্ব এক বন্ধ ইটিং হাউজ মিলে অদ্ভূত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আজ জ্বলে চলেছেন অগ্নিদেব। এক শতাব্দীরও অধিক সময় ধরে সম্প্রীতির বার্তা বহন করে চলেছে এই মন্দির।​

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...