প্রসন্ন। সৌম। গৌরবর্ণ। অনাড়ম্বর। পরনে ধুতি পাঞ্জাবী। সর্বাঙ্গে শুভ্রতার শুচি।
রবীন্দ্রনাথ, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় কে বলেছিলেন, “আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নয়, খাঁটি খনিজ সোনা।”
বকুল বাগানের বাস ভবনে এক সম্বর্ধনায় নিজের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, “ আসলে আমি আধা মিস্ত্রি, আধা কেরানী”।
অভিধান তৈরি আর পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রির কাজ, মহাকাব্য অনুবাদ কেরানীর কাজ।
শুধু মহাকাব্য নয়, শ্রীমদভগবতগীতারও অনুবাদ করেছিলেন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ব্যাখ্যা।
রাজ শেখর বসু। পরশুরাম।
১৮৮০-র ১৮ মার্চ বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে মামাবাড়িতে জন্ম। বাবা চন্দ্রশেখর বসু নদীয়ার মানুষ। দ্বারভাঙ্গা রাজ- এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। ছয় সন্তানের মধ্যে রাজ শেখর দ্বিতীয়।
প্রথম জীবন দ্বারভাঙ্গায়। বাংলা বলতে পারতেন না ছোটবেলায়।। স্কুল-কলেজ বিহারেই।
১৮৯৯ তে কলকাতায় প্রথম পা। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিষয় রসায়ন আর পদার্থবিদ্যা। ওই কলেজের ছাত্র হিসেবেই রসায়নে এম.এ পাস করলেন। দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম হয়ে। সে বছর রসায়নে প্রথম শ্রেণী কেউ পায়নি।
দু’বছর পর রিপন কলেজ থেকে বি.এল ডিগ্রি। তাঁর আইনপেশার আয়ু মাত্র তিনদিন।
রাজশেখরকে অনেক বেশি টানত বিজ্ঞান। দেখা করলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। সদ্যজাত বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের ম্যানেজার। গবেষণা ও ব্যবসা পরিচালনা দুই ক্ষেত্রেই সফল। আমৃত্যু পদে ছিলেন সংস্থার ।
সাহিত্যিক জীবনের শুরু ১৯২০-র দিকে। একটি মাসিক পত্রিকায় ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ নামে ব্যঙ্গগল্প বেরোল। কলমধারী পরশুরামকে চিনল বাঙালি।
যে গল্প বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছিল তাঁকে তিনি খুব একটা নম্বর দেননি। তাঁর লেখাকে রস সাহিত্যের অভিধা দেওয়া হত। সে নিয়ে বলেছিলেন রসসাহিত্য আবার কী! আমি কি হাঁড়িতে রস ফুটিয়ে তৈরি করি?”
সংস্কৃতে পাণ্ডিত্য ছিল। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস এর মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বাল্মিকি রামায়নও।
বাংলা ভাষায় অভিধানের কাজ করেছিলেন। চলন্তিকা। অনুবাদ করেছিলেন মেঘদূত। প্রকাশিত গ্রন্থ ২১ টি। তার মধ্যে বিজ্ঞানও ছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে তাঁকে ডি.লিট সম্মান দেওয়া হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার। সাহিত্য একাডেমী পেয়েছিলেন, ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করে।
তাঁর লেখা 'পরশপাথর', এবং 'বিরিঞ্চিবাবা'(ছবিতে 'মহাপুরুষ') সিনেমার রূপ দেন সত্যজিৎ রায়, যেগুলি যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল।
তিলজলায় লুম্বিনী পার্ক-এর নিজের জমি মেন্টাল হাসপাতালে দান করেছিলেন।
১৯৬০- এর ২৭ এপ্রিল। বেলা সওয়া একটা। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন পরশুরাম।
তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় বলেছিলেন, তিনি যেভাবে গেলেন তার চেয়ে ভালভাবে কে কবে গেছেন?