বইপাড়ার পানের কথার প্রথম পর্বে আমরা গরম পানীয়ের কথা জেনেছি, আজ জানব ঠান্ডা পানীয়ের কথা, এই পানীয় হল তৃপ্তির চুমুক। ভারতের প্রাচীনতম তৃপ্তির পানীয়ের নাম শরবত। যদিও তার জন্মস্থান নিয়ে বেশ মত বিরোধ রয়েছে। একদা এই শরবতের নাম ছিল পানা। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আপনার বাম দিক বরাবর একমিনিট হেঁটে এসে, ডানদিকে প্রথম যে রাস্তাটা পড়বে তা বরাবর সোজা এক মিনিট হাঁটুন। চোখের সামনেই পড়বে শরবতের স্বর্গরাজ্যের হদিশ। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, কলেজ স্কোয়ারের ঠিক পিছন দিকে এর রাজকীয় অবস্থান। প্রথম ঠিকানা ছিল ১/এ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, আর এখনকার ঠিকানা হল ১/১/১ডি বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট।
যার কথা হচ্ছে তার নাম প্যারামাউন্ট; কলেজ স্ট্রিটের প্যারামাউন্ট শরবতের দোকান। প্যারামাউন্ট কখনও বিজ্ঞাপন করে না। প্যারামাউন্টের ইতিহাস ঐতিহ্যই এর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। মানুষের আস্থা আর মুখের কথাই তাদের বিজ্ঞাপনী প্রচার। সাবেক বাঙালির অহঙ্কার এবং সাংস্কৃতিক শৌর্যের একাকার মিশেল হল শরবতের অমরাবতী, প্যারামাউন্ট। বইপাড়ার আবহমান তৃষ্ণার শান্তি দেখতে দেখতে শতক পেরিয়ে ফেলেছে।
বরিশালের বিপ্লবী, তরুণ সতীন সেনের সঙ্গে পকেটে চারটি পয়সা নিয়ে শিয়ালদহে নেমেছিলেন নীহাররঞ্জন। দিঘির পিছনের বাড়িটায় বরিশালের অনুশীলন সমিতির তরুণদের আড্ডা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েই শরবতের দোকান চালু হল। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নীহাররঞ্জন তখন হামিদা পালোয়ানের আখড়ায় কুস্তি শিখছেন। পুলিনবিহারী দাসের কাছে লাঠিখেলায় দীক্ষা।
শারীরচর্চা, স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে শরবত-সেবাও মূল্যবোধের আর এক নাম হয়ে উঠল। ১৯১৮ সালে বরিশালের নীহাররঞ্জন মজুমদার কলকাতা এই প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন, তখন এর নাম ছিল প্যারাডাইস। কিন্তু শরবত বিক্রি তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। শরবতকে সামনে রেখে দোকানের পিছনে চলত স্বদেশী কাজ কর্ম। এটি ছিল বিপ্লবী সতীন সেন-এর অঘোষিত কার্যালয়, স্বদেশী অনুশীলন কেন্দ্র। নেতাজি বাঘাযতীনের মতো বিপ্লবীরা এখানে আসতেন। জাল-পাতা আসনের যে কাঠের চেয়ারে বসতেন সুভাষচন্দ্র, তার সামনে ইতালিয়ান মার্বেল টপ দুধসাদা টেবিল।
আজও দোকানের দেওয়ালে স্টাফ করা হরিণের শিং দেখা যায় আর সঙ্গে একটা বোর্ড। যেসব বিখ্যাত মানুষের পদধূলিতে ধন্য এই শরবত পীঠ তাঁদের নামের তালিকা। বিভিন্ন মণীষীদের ছবি রয়েছে। টেবিলটপগুলো সেই সময়ের ইতালিয়ান মার্বেলের। কলেজ স্ট্রিটের মেসবাসী গরিব ছাত্র, প্রেসিডেন্সি-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখ থেকে লাহাবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, রাজপরিবারের অভিজাতদের এক ঘাটে মিলিয়ে দিয়েছিল প্যারামাউন্ট।
প্যারামাউন্ট-এর ইতিহাস সুদীর্ঘ রয়েছে, সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে প্যারামাউন্ট। কিন্তু এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে এসেছে নানান বিপদ। এক গ্লাস শরবতের আড়ালে চলত গুপ্ত সমিতির কাজ। কিন্তু ব্রিটিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্বদেশীদের এই গোপন আস্তানা একদিন ধরা পড়ে গেল। পুলিশ এসে বন্ধ করে দিল শরবতের দোকান। কেটে গেল অনেকগুলো বছর। ফের ১৯৩৭ খুলল দোকান খুলল। এবার প্যারাডাইস-এর নাম বদলে প্যারামাউন্ট নাম রাখা হল।
নজরুল থেকে সত্যজিৎ, উত্তম কুমার থেকে সুচিত্রা; সকলেই এখানে নিয়মিত আসতেন। মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায় থেকে শুরু করে শচীন কত্তা, উদয়শঙ্কর কে আসেননি এখানে। শরবতের টানে সময় পেলেই প্যারামাউন্টের শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে কিংবদন্তিরা হানা দিতেন বইপাড়ায়। শরবতের যে কত বিচিত্র রকমফের হতে পারে তা প্যারামাউন্টে না ঢুকলে জানা যাবে না। এখানকার হার্ট থ্রব হল ডাবের শরবত। এক গ্লাস বা দুই-তিন গ্লাস চুমুক দিয়েই বলে উঠবেন আহা!
শোনা যায়, এই শরবতের রেসিপির আবিষ্কারক হলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। প্যারামাউন্ট মানে ডাবের শরবত। সবার জানা। এই ডাব আনা হত বসিরহাট থেকে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নীহাররঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন কীভাবে ডাবের শাঁস মিশিয়ে শরবতে আনতে হবে নতুন স্বাদ। চা-পানে ঘোর বিতৃষ্ণা ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের। ভারতে চায়ের প্রচলনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনও করেছিলেন। পরাধীন দেশের ছেলেছোকরাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় পেট ভরানো, স্বাদু, পুষ্টিতে ঠাসা শরবতের পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন প্যারামাউন্টের প্রাণপুরুষ নীহাররঞ্জন মজুমদারকে।
তাঁদের ধ্রুপদী ডাবের শাঁস ভরপুর সরবতের এটাই জন্ম-কাহিনি। শাঁসে পেট ভরবে, ডাবের জলে বুক জুড়োবে। এই শরবতেই অন্য মাত্রা জুড়তে কিছু বিদেশি এসেন্সের তুকতাক শিখিয়ে দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্যারামাউন্টের কর্তারা সেই রেসিপি গোপনে আগলে রেখেছেন। ভারতীয় বিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতিমের রেসিপিতেই প্রায় একশো বছরেরও বেশি ধরে টানা ব্যাট করে যাচ্ছে প্যারামাউন্টের ডাবের শরবত। অন্যান্য উপাদান বাজারে পাওয়া গেলেও, ডাব শরবতের জন্য স্পেশাল জোগানদার আছেন, দোকানে ঢুকলে দেখা যায় এক পাশে সার দিয়ে ডাব রাখা রয়েছে!
ছোট দোকান, একসঙ্গে ২০ জনের মতো বসার ব্যবস্থা রয়েছে। যদি বসার জায়গা না থাকে বা বাড়ির জন্য নিয়ে যেতে চাও এদের টেক অ্যাওয়ে সার্ভিসও আছে। এমনকি বিয়ে সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্যারামাউন্ট শরবত পরিবেশন করে থাকে। সোমবার থেকে শনিবার সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
শুধু ডাবের শরবত নয়, প্যারামাউন্টের অন্য বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নাম হল, গ্রেপস ক্রাস, মাঙ্গম্যানিয়া প্রমুখ। কোনও কৃত্রিম রং মেশানো হয় না প্যারামাউন্টের শরবতে। আদি যুগের ডাব বা কমলা-আনারস-ভ্যানিলা ফ্লেভারের সঙ্গে সম্প্রতি ‘প্যাশন ফ্রুট’ বা মালাই-আরোপিত পাকা আমের ‘ম্যাঙ্গো ম্যানিয়া’ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত তিন রকম শরবত পাওয়া যায় এখানে। স্পেশাল ড্রিঙ্ক, ক্রীম বেসড ড্রিঙ্ক আর সিরাপ। স্পেশাল ড্রিঙ্কের মধ্যে পাওয়া যায় কোকো মালাই, পাইন্যাপেল মালাই, স্ট্রবেরি মালাই, রোজ মালাই, ভ্যানিলা মালাই, গ্রেপস ক্রাশ আর কোল্ড কফি।
এছাড়া প্যাশন ফ্রুট আর ডাব শরবত ও ড্রিঙ্কের মধ্যে পড়ে। ক্রীম বেসড ড্রিঙ্কের মধ্যে রোজ, ব্যানানা, লেমন, অরেঞ্জ, পাইনঅ্যাপেল, গ্রীন ম্যাঙ্গো, ভ্যানিলা উল্লেখযোগ্য। সিরাপের মধ্যেও পাওয়া যায় - রোজ, লেমন, অরেঞ্জ, গ্রীন ম্যাঙ্গো, লিচু এমনকি ট্যামারিন্ড বা তেঁতুলের সিরাপ ও পাওয়া যায়। একসময়ে এখানে সফটড্রিঙ্কস আর আইসক্রীম পাওয়া গেলেও এখন শুধুমাত্র শরবত আর সিরাপই পাওয়া যায়। এগুলো বাজার চলতি সফটড্রিঙ্কসের মতো শুধুমাত্র ক্যালরি বর্ধক নয়; খাদ্যগুণ সমৃদ্ধও বটে। আর দেরি নয়, চৈত্র আসছে একবার এসে গলা ভিজিয়ে যান।