খেলার ময়দান আর যুদ্ধের ময়দান। এই দু’য়ে বিশেষ তফাৎ নেই ওঁদের কাছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারানোর পরাক্রম আর সাহসে, মহাকাব্যের বীরদের থেকে কোনও অংশে কম নয়।
কেউ হুইলচেয়ারে, কারোর পা অকেজো, কারো বা হাত অক্ষম, চোখের আলোয় দুনিয়া দেখার সুযোগটুকুও নেই। সেই ‘আটকে’ যাওয়ার কাছে নতিস্বীকার করেননি ওঁরা। বরং চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন প্রতিদিন। নিজেদের জোর খুঁজে পেতে।
সেই শৌর্যের গর্জনই ফের দেখতে চলেছে পৃথিবী। আবার গোটা বিশ্বের নজর এখন টোকিওর দিকে।
অলিম্পিক্সের-২০২০র পর প্যারালিমিপিক্স গেমসের জন্য প্রস্তুত সূর্যোদয়ের দেশ।
এই প্রতিযোগিতায় কোনও হার-জিত নেই পুরোটাই চ্যালেঞ্জ। অক্ষমতাকে ছাপিয়ে যাওয়া লড়াই। আর বহু অচেনা মুখের কাছে জীবন যুদ্ধের জেদকে চারিয়ে দেওয়া। প্যারালিম্পিক্স গেমসের আয়োজনের উদ্দ্যেশ্যই তাই।
অতিমারীর কারণে এক বছর পিছতে হয় প্যারালিম্পিক্স। একটা সময় অলিম্পিক্সের মতোই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল।
প্রতিযোগীরা কিন্তু তাঁদের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। কিন্তু চালিয়ে গিয়েছেন প্র্যাকটিস।
২০২০-র প্যারালিমিপিক্সে ২২ ইভেন্টে ১৪৩ দেশ অংশগ্রহণ করছে। নতুন সংযোজন ব্যাটমিন্টন ও তাইকোন্ডো। প্রতিযোগীর সংখ্যা ৪ হাজার পাঁচশো ৩৭।
এবারের প্যারালিম্পিক্সের আসরে নজর কাড়ছে ভারতও। শুরু থেকেই। ৫৪ সদস্যের প্যারা-অ্যাথলিট দল পাঠিয়েছে ভারত। প্যারালিমিপিক্স ইতিহাসে ভারতের এত বড় দল এই প্রথম।
টোকিও অলিম্পিক্সের সাফল্য বাড়তি টনিকের কাজ করছে। ভারতীয় প্রতিযোগীদের মধ্যে বেড়েছে পদকের খিদেও।
টোকিও প্যারালিম্পিক্সে ভারত মোট ৯ ইভেন্টে অংশ নেবে। তার মধ্যে রয়েছে আর্চারি, অ্যাথলেটিক্স, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, শুটিং, সাঁতার, কুস্তি, ভারত্তোলন, তাইকোন্ডো।
প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে ২৪ আগস্ট থেকে, চলবে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিযোগিতায় ভারতের শেফ-অফ-দ্য-মিশন গুরুশরণ সিং আত্মবিশ্বাসী দেশের সাফল্য নিয়ে। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের প্রতিযোগীরা যে ফর্মে রয়েছে তাতে সোনা সমেত গেমসে অন্তত ১৫ পদক আশা করাই যায়।
টোকিও প্যারালিম্পিক্সে রওনা হওয়ার আগেই নতুন রেকর্ড করে ঝড় তুলেছেন রাজস্থানের ‘স্টার’ প্রতিযোগী দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া। চল্লিশ পার করেছেন। কিন্তু জ্যাভেলিনের ময়দানে বয়স তাঁর কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। ছোটবেলায় বিদ্যুতের ছোবলে একটা হাত কাজের ক্ষমতা হারায়।
২০০৪ সালে এথেন্সে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছিলেন দেবেন্দ্র। ২০১৬ সালে রিওতে ফের নিজের রেকর্ড ভেঙে, নয়া রেকর্ড গড়ে সোনা আর ক্রীড়া দুনিয়ার মন দুই-জিতে নিয়েছিলেন এক সঙ্গে।
এহেন দেবেন্দ্র, এবার টোকিও অলিম্পিক্সের আসরের উদ্দ্যেশে রওনা হওয়ার আগে জহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ফের নতুন রের্কড গড়েছেন। জাপান পাড়ি দেওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সোনা জিততে যাচ্ছেন তিনি।
প্যারা টেবিল টেনিসে হুইলচেয়ার ক্লাস ৪ ও ৩ বিভাগে গুজরাটের দুই ক্রীড়াবিদ শুরু থেকেই নজরে। ভাবিনা প্যাটেল এবং সোনাল প্যাটেল। এই দুই ক্রীড়াবিদের দিকে তাকিয়ে টেবিল টেনিস থেকে পদক প্রাপ্তির আশা করছে ভারত।
২৫ আগস্ট কোয়ালিফাইং রাউন্ডের লড়াই।
প্যারা পাওয়ারলিফটিং বিভাগে ভারতের হয়ে নামবেন বিশ্বসেরা দুই অ্যাথলিট জয়দীপ এবং সাকিনা খাতুন।
জ্যাভলিন চ্যাম্পিয়ন সুন্দর সিং গুর্জর, অজিত সিং সন্দীপ চৌধুরী এবং হাইজাম্পার মরিয়াপ্পান থঙ্গাভেলুও এ বার প্যারালিম্পিক্সে অংশ নিচ্ছেন।
প্যারা ব্যাডমিন্টনে প্রমোদ ভগত, কৃষ্ণ নাগর, তরুণ ধীলন তারকা ক্রীড়াবিদ।
তীরন্দাজিতে রাকেশ কুমার, শ্যাম সুন্দর, বিবেক চিকারা এবং হরবিন্দর সিং। একমাত্র মহিলা আর্চার হিসেবে অংশগ্রণ করছেন জ্যোতি বালিঁয়া। পদকের জন্য এদের দিকেই তাকিয়ে দেশ।
প্যারালিম্পিক্সে ভারত প্রথম পদক পেয়েছিল সাঁতারে। সেটা ১৯৭২ সাল। ৬৫-র ইন্দো-পাক যুদ্ধের রেশ। সেই আবহেই জার্মানিতে আয়োজিত প্যারালিমিপিক্সে অংশ নিয়েছিলেন সাঁতারু মুরলিকান্ত পেটকর। ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে সোনা জিতেছিলেন। সবচেয়ে কম সময়ে শেষ করে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন।
এবার করোনার জেরে একরকম যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে গোটা পৃথিবী। তার বাইরে নয় ভারতও। খেলার ময়দানে হার না মানা জেদ আর সাফল্যের কাহিনী অতিমারীর সময়ে কোন নতুন নজির তৈরি করে, সে দিকে তাকিয়ে মুহূর্ত গুনছে ক্রীড়া দুনিয়া। ভারতবাসীও অপেক্ষায়...