লক্ষ্যের পথে অবিচল প্যারা-অ্যাথলিট অজিত সিং যাদব

জীবন। বড় আশ্চর্য এক যাত্রাপথ। কখনো ভরিয়ে দেয় প্রাপ্তিতে কখনো আবার রিক্ত করে, নিঃস্ব করে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের দেখানো পথে কখনো যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়? ঠিক কতটা সাহস থাকলে একটা মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার সেই একই স্বপ্ন দেখতে পারে, যেখান থেকে সে শুরু করেছিল তার স্বপ্ন দেখার যাত্রাপথ?

অজিত সিং যাদব এমনই এক মানুষ যিনি দুঃস্বপ্নের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে স্বপ্ন দেখার যাত্রাপথে হাঁটতে পারেন। এবছর প্যারা-অলিম্পিকে যোগদানকারী এই 'জ্যাভলিন থ্রোয়ার' সাহসিকতার সমার্থক নাম।

para 1

সময়টা ২০১৭। দুই বন্ধু যাচ্ছিলেন ট্রেনে চড়ে। এক বন্ধুর বিপদ দেখে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন আরেক বন্ধু। কিন্তু বাঁচাতে গিয়ে নিজেই আচমকা পড়ে যান ট্রেন থেকে। শরীরের অসংখ্য হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ছেলেটির। শুধু তাই নয়, কনুইয়ের নিচে থেকে বাদ পড়ে বাঁ হাত। এই ছেলেটি স্বপ্ন দেখতেন অধ্যাপক বা শিক্ষক হওয়ার। তবে আগ্রহের জায়গা ছিল খেলা। অনেকেই ভেবেছিলেন এখানেই সব স্বপ্নের ইতি।

কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার জায়গা থেকেই শুরু হয় নতুন স্বপ্ন দেখা। খেলার জগতে আসেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ছেলেটি। শিক্ষকতা বা অধ্যাপনা নয় বেছে নেন মাঠে নেমে 'খেলা'। জ্যাভলিন থ্রোয়ার হয়ে ওঠেন। দুঃস্বপ্নের অভিমুখ ঘুরিয়ে সঠিক নিশানায় বর্শা ছোড়া। এ বছরের প্যারা অলিম্পিকে স্বপ্নের আরেক নাম অজিত সিং যাদব।

১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্ম উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রামে। কৃষক পরিবারের সন্তান। ছোট থেকেই নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন জীবনে। তবে ২০১৭ সালের ট্রেন দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের গতি পাল্টে দেয়। চিন্তাভাবনা শুরু করেন ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠার। শুরু হয় প্রশিক্ষণ। মানসিকভাবেও অবসাদ গ্রাস করেছিল তাঁকে। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেন। মনের জোর হারাননি। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সঙ্গে নিজের শরীরের একটা অংশ না থাকলেও মনের জোর বাড়িয়ে নেন কয়েকগুণ। ট্রেন দুর্ঘটনার চার মাস পরেই প্রতিযোগিতায় যোগদান করেন প্যারা-অ্যাথলিট হিসেবে।

বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য ভারত সরকারের একটি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হন অজিত। আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্তরের বর্শা ছোড়া প্রতিযোগিতায় নিয়মিত যোগদান করতে থাকেন। বরাবর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। ২০১৮ সালে প্রথমবার হরিয়ানার পাঁচকুলায় সিনিয়র ন্যাশনাল প্যারা-অ্যাথলিট চ্যাম্পিয়নশিপে যোগদান করেন। ২০১৯ সালে প্রথমবার আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার সুযোগ পান। চায়নায় অনুষ্ঠিত সপ্তম প্যারা-অ্যাথলিট গ্রাঁ প্রি-তে সোনার পদক জিতেছিলেন এই দুঃসাহসী প্রতিযোগী। ২০১৯ সালেও দুবাইতে চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি অপেক্ষা করছেন টোকিও অলিম্পিকের জন্য, যা তাঁর স্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

para 2

বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ বরাবর তাঁর যাত্রাপথ হয়েছে। কখনোই জেতার শর্ত নিয়ে মাঠে নামেননি। শিক্ষাগ্রহণই ছিল মূল লক্ষ্য। একটি প্রতিযোগিতার পরে তিনি বলেন "আমি আমার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে জ্যাভলিন ছুড়েছিলাম। তারপরেও চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলাম। পদক জয়ের থেকেও আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করা এবং প্যারা-জ্যাভলিন সম্পর্কে আরো বেশি শিক্ষাগ্রহণ করা"।

তাঁর সাফল্যের জন্য সবসময় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন কাছের মানুষদের। "ওঁরা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। আমার লক্ষীবাই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের কোচ এবং মেন্টররা সময় আমায় আমার লক্ষ্যের দিকে গাইড করেছেন''। বর্তমানে ভি.কে.দাবাস-এর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অজিত।

অজিত সিং যাদব এখন দুঃসাহসের আরেক নাম। স্বপ্নের অভিমুখ ঘুরিয়েয়ে দেওয়ার সাহসিকতার অধিকারী। তাঁর স্বপ্ন-পথে সাফল্যের অপেক্ষায় সারা ভারতবাসী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...