হিকির গেজেট

বানিজ্যের কেন্দ্র। রাজধানী শহর। ক্রমশ ঘন হচ্ছে ব্রিটিশ জনবসতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্ম পরিচালনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ভিড় বাড়ছে সুতানুটি- গোবিন্দপুর- কলকাতায়। বসত গড়ে তুলছে ইংরেজরা। নিত্য নতুন ঘটনার ঘনঘটা। কিন্তু কোনও সংবাদপত্র নেই। ছাপা খানাও দুর অস্ত।

 ১৭৬৮ সাল নাগাদ ভারতবর্ষে প্রথম গেজেট প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। উইলিয়াম বোল্টস। কিন্তু ছাপাখানার অভাবে তাঁর উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসেনি। কর্মচারী হবার সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক গোপন গল্প তিনি জানতেন। তাই কোম্পানি খুব একটা সুযোগ দেয়নি তাকে। রাতারাতি তাঁকে নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বোল্টস অবশ্য প্রচার করেছিলেন ছাপাখানার সুবিধা না থাকায় অসুবিধা হচ্ছে। সমস্যা মেটাতে তিনি খুব তাড়াতাড়ি এদেশে ছাপাখানার বন্দোবস্ত করবেন।   

তারও এক যুগ পর ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকাশিত হয় 'দ্য বেঙ্গল গেজেট’১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারিতে। ইংরেজি ভাষায়। বেঙ্গল গেজেটকে হিকির গেজেট নামেও ডাকা হত।

পত্রিকাটির মালিক, সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি।

১২ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৮ ইঞ্চি প্রস্থ। দুপাতার এই পত্রিকা। প্রতিটি পাতায়

তিনটি করে কলাম। বেশীর ভাগটাই বিজ্ঞাপন। এছাড়া কলকাতা আর মফস্বলের চিঠি।

১৭৭৪ সালে ভারতে আসেন। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম থেকে।

প্রথমে তিনি ঠিক করেছিলেন জাহাজের ব্যবসা করবেন। সঙ্গে ওষুধের ব্যবসা। জাহাজের ব্যবসায় যদি লোকসান হয় তাহলে ওষুধের ব্যবসা।

 শেষ পর্যন্ত দুটোর কোনটাতেই সফল হতে পারেন নি। ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান।

ভাগ্যের হাল ফেরাতে খবরের কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রকাশিত হয় দ্য বেঙ্গল গেজেট’

বেঙ্গল গেজেট, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রিত ইংরেজি পত্রিকা। প্রকাশিত হত কলকাতা থেকে। সার্কুলেশন মেরেকেটে ২০০ র কাছাকাছি।

পত্রিকার জন্য একটা ট্যাগলাইন-ও ব্যবহার করতেন হিকি সাহেব। (A Weekly Political and Commercial Paper, Open to all Parties, but influenced by none’)- ইংরেজি এই লাইনগুলো লেখা থাকত পত্রিকায়।

জোহান জাকারিয়াস কিয়েরন্যানডার নামে এক মিশনারি হিকির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন। পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল মিথ্যা মামলার। সেই মামলাই পথের ভিখারি করে দেয় হিকিকে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ব্রিটিশ রাজের রোষানলে পড়েছিলেন একই সঙ্গে।

তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের ভুল নীতির কঠোর সমালোচনা করে চিঠি ও খবর প্রকাশিত হতে থাকে এই গেজেটে। কোথায় কী ধরনের বেআইনি কাজ কর্ম আর দুর্নীতি চলছে সে নিয়ে নিয়মিত খবর করতেন হিকি। হেস্টিং-এর পরিবার সম্পর্কেও বিভিন্ন রকম লেখা চালাচ্ছিলেন। ছেড়ে কথা বলেননি বিচারপতি ইলিজা ইম্পেকেও। সব মহলকে একই সঙ্গে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। সাহসী সংবাদ প্রকাশের ফলে হিকির গুণমুগ্ধের সংখ্যা বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল শত্রুর সংখ্যা। গোটা ইংরেজ প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একের পর এক খবর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল হেস্টিংস আর ইলিজা ইম্পেকে। গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস আর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলিজা ইম্পে প্রচণ্ড ক্ষেপে যান হিকির ওপর।

গভর্নর জেনারেল পরিষদে হেস্টিংসের প্রবল বিরোধিতা করতেন এক সদস্য। ফিলিপ ফ্রান্সিস। তিনিই ছিলেন হিকির কাগজের পৃষ্ঠপোষক।

কোম্পানির বিরুদ্ধে হিকি একের পর এক আক্রমণ শানালেও ফ্রান্সিসের ছত্রছায়া তাঁকে বাঁচিয়ে দিত। তিনি যতদিন ভারতে ছিলেন হিকির গায়ে তত দিন কোনো আঁচড় লাগেনি।

কিন্তু তারপরই একের পর এক ধাক্কা আসতে শুরু করে বেঙ্গল গেজেটের ওপর। হেস্টিংস একের পর এক মামলা করতে থাকেন হিকির বিরুদ্ধে। তাঁকে জেলে যেতে হয়।

 হেস্টিংসের কারসাজিতেই ১৭৮২ সালের মার্চে প্রধান বিচারপতি ইম্পে বাজেয়াপ্ত করে হিকির প্রেস।  ছাপার কাগজ, যন্ত্রপাতি সমেত। ২৩শে মার্চ প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় দ্য বেঙ্গল গেজেটের।

উইলিয়ম হিিক, হিকির আইনজীবী তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছিলেন, as a member of  Englands upper class in the eighteenth century, hickey represented clients in india, the west indies and England, all of which he had documented in vibrant detail in the diary.”

চরম দারিদ্র্যের মধ্যে মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চিনের উদ্দেশে জাহাজে যাত্রা করেন হিকি। 

১৮০২ এর অক্টোবর মাসে উঠে বসেন ‘অ্যাজাক্স’ জাহাজে। ছদ্মবেশে অসুস্থ শরীরে। চীনের ক্যানাটনে। সঙ্গে কিছু ডাক্তারি বই আর ওষুধপত্র।

চীন পর্যন্ত আর পৌঁছতে পারেননি।

১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেটে’  প্রকাশিত হয় ছোট্ট একটি খবর- ‘চীনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষনিঃশ্বাস ফেলেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি।’

হিকির মৃত্যু স্বাভাবিক কিনা সে প্রশ্নও উঠেছিল। অনেকে মনে করেন জাহাজের বৃদ্ধ অসুস্থ হিকিকে জাহাজের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরে মৃতদেহ ডুবিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রের জলে। 

হিকি খুব জনপ্রিয় ছিলেন সেনাদের কাছে। ইংরেজরা তাঁকে বলত, ‘papa of indian press’.

তাঁর নামে কলকাতার ডেকার্স লেনের নতুন নামকরণ করা হয়, ‘জেমস হিকি সরণি’

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...