ম্যাচ গড়াপেটায় নাম জড়িয়ে গিয়েছে। নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশের ফুটবল ফেডারেশন। তিন বছরের জন্য সবরকমের ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন। এক কথায় ফুটবলের খলনায়কের তালিকায় মোটামুটি নাম উঠে গিয়েছে। কেরিয়ার শেষ। একজন ফুটবলারের কেরিয়ার থেকে তিনটে বছর চলে গেলে যা হয় ঠিক সেটাই হচ্ছিল রোসির সঙ্গে কিন্তু তিনি তো ফুটবলটাকে মন থেকে ভালোবেসেছেন কিছু ভালো তো পাওনা থাকেই। সেটাই হয়েছিল, আর সুযোগের সেরা ব্যাবহার করেছিলেন ইতালির খলনায়ক থেকে নায়ক হয়ে ওঠা ফুটবলার।
পাওলো রসি যখন ৮২ বিশ্বকাপের গ্ৰুপ লিগের ম্যাচ খেলছেন তাঁকে ধুয়ে দিচ্ছে ইতালির ফুটবল ফ্যান থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমগুলি। সেখান থেকেই ফিরে আসেন তিনি। আসলে তৎকালীন ইতালির জাতীয় দলের কোচ এনজো বেয়ারজট তাঁর উপর ভরসা রেখেছিলেন। ভরসার ফল যে এত ভালো হবে সেটা হয়তো তিনি ভাবেননি। ভেবেছিল রসির পা। প্রথম পর্বে চুড়ান্ত ব্যর্থ ফুটবলার জ্বলে ওঠেন নক আউট পর্ব থেকে এবং ইতালির বিশ্বজয়। পাওলো রসি যেন স্বর্গের দূত হয়ে আসেন ইতালির ফুটবল প্রেমীদের কাছে।
কিন্তু ফুটবল অন্ত প্রাণ ছেলেটা কীভাবে খলনায়ক হয়ে উঠেছিল? ১৯৮০ সাল, ভিসেঞ্জা থেকে রোসি লোনে পেরুগিয়াতে যান। এখানেই ঘটে যায় জীবনের সবচেয়ে বড় ও খারাপ ঘটনা। সিরি এ'র সাতটি ক্লাব একসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ম্যাচ গড়াপেটায়। যা টোটোনেরো কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত। ওই সাত ক্লাবের মধ্যে রোসির ক্লাব পেরুগিয়াও ছিল। কেলেঙ্কারি প্রমাণিত হয়। অভিযুক্ত সাত ক্লাবের কোচ, ম্যানেজার এবং খেলোয়াড়দের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়। সেই তালিকায় রসিও ছিলেন। ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন তিন বছরের জন্য তাঁকে নিষিদ্ধ করে।
কেরিয়ারের সেরা সময়ে তিন বছর ব্যান! এমন দুঃসময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় পুরনো ক্লাব জুভেন্টাস। ওই ক্লাব তাঁর নিষেধাজ্ঞা কমানোর জন্য আবেদন করে। ইতালির জাতীয় দলের কথা ভেবেই এই আবেদন করেছিল তাঁরা, কারণ সামনে ছিল বিশ্বকাপ। আবেদন মঞ্জুর হয়। নিষেধাজ্ঞা কমে এবং রসি বিশ্বকাপের আগেই মাঠে নামার সুযোগ পান।
কিন্তু এতদিন মাঠের বাইরে থেকে হারিয়েছে পুরনো টাচ, স্কিল, দক্ষতা, দৌড়। সেই ছন্দ নেই। প্রথম তিন ম্যাচ মাঠে খুঁজেও পাওয়া যায়নি রোসিকে। এরপরেও কোচ এনজো বেয়ারটজ তাঁর ওপর ভরসা রাখেন। তাঁকে বিশ্বকাপের মূল দলে রাখেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতালি জুড়ে বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়। বিশ্বকাপ শুরু হতে সেই বিতর্ক আরও প্রকট হয়। আসলে গ্রুপের ম্যাচে মাঠের এমাথা ওমাথা করা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি রোসি। এনজোকে হাল ছাড়েননি। দাম দিয়েছিলেন স্ট্রাইকার।
দ্বিতীয় পর্বে ইতালি মুখোমুখি দুই সাউথ আমেরিকান জায়েন্ট। প্রথমে আর্জেন্টিনা, তারপর ব্রাজিল। ব্রাজিলের ম্যাচের আগে পর্যন্ত কোনও মতে বেরিয়ে যায় ইতালি। কিন্তু ইতালির সমর্থকরা মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলেন বাড়ি ফিরতে হবে শূন্য হাতেই কারণ আশির দশকের সেরা দল ব্রাজিল। সক্রেটিস, ফ্যালকাওয়ের ব্রাজিলকে রুখতে গেল গোল করতে হবে। সে সব তো বন্ধ হয়ে রয়েছে রসির দয়ায়।
এই মঞ্চের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচের ৫ মিনিটেই হেডে গোল করে এগিয়ে দেন ইতালিকে। ১২ মিনিটে ব্রাজিলের সক্রেটিস দলকে সমতায় ফেরান। ২৫ মিনিটের মাথায় চোখ ধাঁধানো শটে রোসি আবার গোল করে ২-১ এ এগিয়ে দেন ইতালিকে। ম্যাচের ৬৫তম মিনিটে ব্রাজিলের ফ্যালকাও গোল করায় স্কোরলাইন ২-২। আবারও স্বর্গের দূত হয়ে নামলেন রোসি। ৭৪ মিনিটে মারকো তারদেল্লির থ্রু বলে করে ফেললেন গোল। ব্রাজিল নকড আউট। হ্যাট্রিক করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি শেষ হয়ে যাননি। সাংবাদিক, সমর্থক মুখে এবার রসি বন্দনা।
সেমিফাইনালে পোল্যান্ডকে একাই উড়িয়ে দেন রসি। এবার জোড়া গোল। ২-০ তে ম্যাচ জিতে ফাইনালে ইতালি। ফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ ছিল তৎকালীন ফুটবলের অন্যতম শক্তিশালী দল পশ্চিম জার্মানি। ফাইনালের মঞ্চকেও নিজের হাতেই রাঙান রোসি। ৫৭ মিনিটে তার দেওয়া গোলেই ১-০ তে এগিয়ে যায় ইতালি। এরপর পুরো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইতালির দিকে। ম্যাচে আর ফেরা হয়নি পশ্চিম জার্মানির। পরে আরও দুটি গোল হজম করে ৩-১ এ ম্যাচ হারে জার্মানরা। বিশ্ব জয় ইতালির। এভাবেই ১৯৮০-এর খলনায়ক থেকে ১৯৮২-এর নায়ক হয়ে যান পাওলো রসি।
যে রোসির বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না, যিনি প্রথম চার ম্যাচে একটাও গোল পাননি, সেই রোসিই ইতালিকে এনে দেন বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টের শেষ তিন ম্যাচে ৬ গোল। পান সোনার বুট। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন।
জাতীয় দলের পাশাপাশি জুভেন্টাসের হয়ে তিনি তিনটি সিরি-এ, একটি কোপা ইতালিয়া, একটি কাপ উইনার্স কাপ, একটি উয়েফা সুপার কাপ এবং একটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছেন। ব্যক্তিগত অর্জনের খাতায় ১৯৮২ সালের ব্যালন ডি’অর আছে। খেলা ছাড়ার পর ফুটবল নিয়েই ছিলেন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন স্কাই সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে। গত বছর প্রয়াত হন বিরাশি বিশ্বকাপে ইতালির নায়ক।