চৈত্র-বৈশাখ আর গরমের পান্তা ভাত বঙ্গদেশে এক সুতোয় বাঁধা। পান্তাভাতের কোনও ‘এপারবাংলা-ওপারবাংলা’ ভেদ নেই। গরম পড়ল তো হেঁশেলে হেঁশেলে পান্তা ভাতের জিরন শুরু।
এপার বাংলায় শহরাঞ্চলে পান্তা পর্বের শুরুয়াত হয়ে যায় শীতলা ষষ্ঠীর ঠাণ্ডা উপোসের সময়। পাড়ায় পাড়ায় চলে পান্তাভাতের পালা। তবে সেই উদযাপন নিরামিষ। পাড়ার নিরামিষ তেলেভাজার দোকানে সেদিন লম্বা লাইন। তবে পেঁয়াজ-রসুন আমিষের ছোঁয়া নৈব নৈব চ।
তারপর যত বাতাসের তাত বাড়তে থাকে তত রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়িতে জোগান বাড়ে পান্তা ভাতের।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় গ্রীষ্মপ্রধান রাঢ়বঙ্গ ও দক্ষিণাংশে পান্তাভাতের চল বেশি। গরমের দিনগুলোতে সকাল-বিকেল ‘পষ্টি’ ভাত খান অধিবাসীরা। জল দেওয়া ভাত খেলে পেট ঠাণ্ডা হয়। সকালে রান্না করা গরম ভাতে জল ঢেলে রেখে দেওয়া হয় দিন ভোর। সেই ভাতও ‘পষ্টি’ ভাত। শুধু আলু সেদ্ধ, নুন, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ দিয়ে জল ঢালা ভাত খেয়েই শুরু হয়ে যায় দিনের নিত্য কাজের পালা।
পান্তা ভাত শুধুমাত্র নিত্যদিনের খাবার নয়, উৎসবের ভোজ অঙ্গও। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিতে ভাজা ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া পূর্ব বাংলার চলতি রেওয়াজ। সঙ্গে থাকে নানা রকম ভর্তা। যত রকম সবজি ততরকম ভর্তা, আর মাছ তো আছেই।
এপার বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন পান্তাভাত খাওয়া হয়। আগের দিন রান্না করে রেখে পরের দিন খাওয়া। উপলক্ষ রান্নাপুজো। এই দিন থেকে কার্যত শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজোর দিনগোনা। আবার দশমীর দিন সকালে দেবী দুর্গাকে পান্তাভাত আর কচুর শাক নিবেদন করে বিদায় জানানোর রীতিও প্রচলিত আছে।
উৎসবে বাঙালির পান্তা ভাত সংস্কৃতি বেশ প্রাচীন। তবে পয়লা বৈশাখের উৎসবে ইলিশ-পান্তার চল কীভাবে শুরু হল তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এখনও পান্তা চরম দাবদাহ যোঝার শক্তি দেয়। চিকিৎসকরা পর্যন্ত বলেন গরমে সুস্থ থাকতে পান্তা ভাত খান। পান্তা ডায়েরিয়া, হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ করে। পুষ্টিমূল্যের দিক দিয়েও পান্তাভাত টেক্কা দেয় অনেক খাবারকেই৷ এমনকি গরম ভাতকেও অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে। অসম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পান্তাভাতের ওপর গবেষণা চালান কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়া। এই গবেষণার ফলাফল পরে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়।
সেই গবেষণায় দেখা গেছে পান্তাভাতে নানা ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টিকর খনিজ পদার্থ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ফসফরাস, ভিটামিন বি ইত্যাদি। সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে এসব পুষ্টিদায়ক পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।
১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রনের পরিমাণ থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে তৈরি পান্তাভাতে এর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হয় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম। একইভাবে ক্যালসিয়ামের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম, সেখানে পান্তাভাতে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫০ মিলিগ্রাম।
পান্তাভাত খেলে ঘুমঘুম ভাব হয়। ভাত ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে রাখলে প্রাকৃতিক নিয়মে তার সঙ্গে কিছু ব্যাক্টেরিয়া (ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া নয়) বিক্রিয়া করে জরিয়ে দেয়। একে সন্ধান প্রক্রিয়া বা ফার্মেন্টেশন বলে। এই পচন প্রক্রিয়ায় ইথাইল অ্যালকোহল তৈরী হয় যা পান্তার জলীয় অংশে (যাকে চলতি ভাষায় 'আমানি' বলা হয়) মিশে যায়। পান্তাভাতের সঙ্গে এই ইথাইল অ্যালকোহল মিশ্রিত আমানি খেলে ঘুম পায়।
পান্তা ভাতের শুরুয়াত নিয়ে যতই বিতর্ক থাক। তার স্বাদ নিয়ে কিন্তু কোনও বিতর্ক নেই। পান্তার স্বাদ খোলে তার আমানির গন্ধে। মৌরলা মাছ ভাজা, ছোট ঝাল চচ্চড়ি, আলু চোখা, ডিমভাজা দিয়ে মেখে এক গাল পান্তা ভাত ভুলিয়ে দিতে পারে গরমের সব কষ্ট। কেউ কেউ আবার বাসি মাছের টক দিয়ে পান্তা ভাতে বেজায় স্বাদ খুঁজে পান! আর এভাবেই হেঁশেলে বেঁচে থাকে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতি।