রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ পঙ্কজকুমার মল্লিক

স্মৃতিকথায় নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যিনি বলেছিলেন, “লোকে শুধু জানুক, এই একজন অনাড়ম্বর মানুষ জীবনের সুদীর্ঘ প্রায় ষাট বছর ধরে সঙ্গীতের সেবা করেছে”। তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক

১৯০৫-র ১০ মে (২৭ বৈশাখ ১৩১২ বঙ্গাব্দে) উত্তর কলকাতার মানিকতলার কাছে চালতাবাগানে তাঁর জন্ম। স্বচ্ছল পরিবার, কিন্তু আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনে আকস্মিক ভাবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। তিনি তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখাতে বাধ্য হন। “এইভাবে ঊঞ্ছ কুড়োনো শেষ করে পরিশ্রান্ত দিন-মজুর আমি ঘরে ফিরতাম রাত বারোটা বা তারও পরে।” ফিরে দেখতেন মা মনোমোহিনী দেবী অভুক্ত অবস্থায় বসে আছেন।

তাঁর পিতা মণিমোহন মল্লিক ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। পূজাপার্বণের দিনগুলিতে বাড়িতে বসত গানের আসর। এমনই এক আসরে প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ দূর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তরুণ পঙ্কজের গান শুনে তাঁকে গান শেখাতে আগ্রহী হলেন। শুরু হল নিধুবাবুর টপ্পা শেখা,  নিয়মিত রেওয়াজ। যদিও ১৭ বছরের তরুণের মন তখন ‘রবিবাবুর গান’-এর খোঁজে আকুল। সেকালে এই মানসিকতা অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ছিল। শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকোর ক্ষুদ্র গন্ডীর বাইরে রবীন্দ্রনাথের গান তখনও তেমন পরিচিতি পায়নি।

দূর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেই পঙ্কজকুমারের হাতে এল ‘চয়নিকা’। বইটির ‘চির আমি’ নামের একটি কবিতায় পঙ্কজকুমার আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। “তার পরে কখন আপনমনে গুনগুন করে কবিতাটির বাণীতে সুর দিতে লেগে গেছি তা নিজেও জানি না”। সেই সুর যখন তিনি ‘আনন্দ পরিষদ’- এর ঘরে অর্গান বাজিয়ে গাইছিলেন তখন পঙ্কজকুমারের সুরকে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুর বলে মনে করলেন লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র। বিষয়টি পঙ্কজ মল্লিককে এক অভূতপূর্ব আনন্দে ভরিয়ে তুলল। তিনি অনুভব করলেন “আমি কেবল সুর দিতেই পারি না, কবির নিজের দেওয়া সুরের সঙ্গে আমার সুর কিনা প্রায় মিলে যায়!”

ঘটনাটি তাঁকে রবীন্দ্রনাথের গান শেখার দিকে আরও একটু অগ্রসর করে দিল। গান তো তিনি ছোট থেকেই গাইতেন। সিটি ইনস্টিটিউশন মাইনর স্কুলে পড়ার সময় পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে স্কুলের এক শিক্ষকের লেখা গান শ্রদ্ধানন্দ পার্কের অনুষ্ঠানে বালক পঙ্কজকুমার গেয়েছিলেন। সেই প্রথম জনসমক্ষে গান গাওয়া। তাঁর এক সুগায়ক আত্মীয়ের কাছে থিয়েটারের একাধিক ভক্তিমূলক গান শিখেছিলেন তিনি। আগ্রহী হয়েছিলেন তাঁর হারমোনিয়াম বাজানো দেখে। কাকার প্রবাসী বন্ধু শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের ঘরে একটি হারমোনিয়াম ছিল। ঘরের চাবি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের মায়ের কাছে। বিধবা পিসিমাকে কাকুতিমিনতি করে চাবি আনিয়ে সেই ঘরে গোপনে নিজে নিজেই হারমোনিয়াম বাজানো শিখলেন। দেশে ফিরে শৈলেন্দ্রনাথ পঙ্কজ মল্লিকের কাছে সব ঘটনা শুনে ও তাঁর গান শুনে সেই হারমোনিয়াম তাঁকেই দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পাওয়ার মূল্য তাঁর কাছে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপ্তির চেয়ে কম ছিল না।

Pankaj-kumar-mallick-base

রবীন্দ্রনাথের গান শেখার আগ্রহে তিনি প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে যেতেন। সেখানে শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান তিনি শিখেছিলেন। ১৯২২ সালে বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানে তিনি নিজেকে উৎসর্গীকৃত করে দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুর দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। যদিও দিনান্তের সেই গানে তরুণ পঙ্কজ সকালের সুর লাগিয়েছিলেন কিন্তু জনপ্রিয়তায় তাতে টান পড়েনি। ‘শেষ খেয়া’ কবিতাটিতে সুর দিয়ে তরুণ প্রাণের উচ্ছ্বাসে তিনি “ছোটোখাটো আসরে, কলেজের অনুষ্ঠানে এই গানটি মহানন্দে পরিবেশন করেছি তখন”। সংবাদ পৌঁছল ঠাকুরবাড়িতেও। ডেকে পাঠালেন রথীন্দ্রনাথ। প্রশ্ন করলেন “আপনি নাকি বাবামশায়ের কী একটা ছায়া ছায়া গান গেয়ে থাকেন?”

 পঙ্কজ মল্লিক তখন বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন যে গানটি তিনি কোথায় পেয়েছেন? ভীত পঙ্কজ জানিয়েছিলেন যে ‘গানের বই’-তে আছে,  স্বরলিপিও আছে। তবে কিনা তাঁর যে বন্ধুর কাছে আছে সে কাশীতে। ফিরে এলেই দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। কেটে গেল একটি মাস। এবার ডাক এল স্বয়ং কবির কাছ থেকে। আনন্দিত পঙ্কজকুমার একবার ভাবলেন ‘মানবজন্মের তীর্থদর্শন’ হবার সুযোগ এসেছে। আবার ভাবলেন কবি যদি তাঁকে ভর্ৎসনা করেন, এমনকি প্রহারও করেন তবে তা ‘অঙ্গের ভূষণ’ করে নেবেন। এবার রথীন্দ্রনাথ সরাসরি বললেন, “দেখুন, গোপন করার দরকার নেই। আমি জেনেছি ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ কবিতাটিতে সুর দিয়ে আপনিই গান তৈরী করেছেন। গানটা বাবামশায় আপনার মুখেই শুনতে চান”। নিরূপায় পঙ্কজকুমার কোনওমতে গানটি রবীন্দ্রনাথের সামনে গেয়েই দরজা দিয়ে সটান জোড়াসাঁকোর চৌহদ্দি পেড়িয়ে হাঁটা দিলেন ‘নিজগৃহপথে’। এত ভয় পেয়েছিলেন পঙ্কজকুমার অথচ এ সুর রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পেয়েছিল অনায়াসেই।

‘অন্ধ গায়ক’ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ঘনিষ্ঠ ছিলেন পঙ্কজকুমার। রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। শেখানোর ধরণে এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন পঙ্কজকুমার যে পরবর্তী সময়ে ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’-এ সেই ধারারই অনুসরণ করেছিলেন। আজীবন দিনেন্দ্রনাথের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি।

চলচ্চিত্রের সঙ্গেও পঙ্কজকুমারের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ফিল্মে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। নির্বাক ছবি দিয়ে জীবন শুরু করে সবাক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এমনই উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন যে তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে পন্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “যশরাজ মিউজিক ডিরেক্টর তো উনি ছিলেনই-সেই সঙ্গে কি দরাজ গলা ছিল, ওঁর গান আমার খুব ভালো লাগত।”

১৯৩১ সালে ‘চাষার মেয়ে’ দিয়ে তাঁর ফিল্মের জীবন শুরু হয়। ১৯৩৫- এ প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবিতে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি এক নতুন দিগন্তের সূচনা করল। গানের রেকর্ডও হল। চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পিত প্রয়োগে পঙ্কজকুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় গান গেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবীর মতো সঙ্গীতশিল্পীরা। তাঁরই আগ্রহে রবীন্দ্রনাথের গানে তবলার প্রয়োগ সম্ভব হয়েছিল। নিউ থিয়েটার্সের সোনালী দিনের অবসান ঘটলেও অনেকে বম্বে চলে গেলেও পঙ্কজকুমার যাননি। এমনকি জার্মান পরিচালক পর জিলহজ যখন "চার অধ্যায়"-এর হিন্দি "জলজলা" করলেন তখনও পঙ্কজকুমার কলকাতাতেই সঙ্গীতের কাজ করেছিলেন। গীতা দত্ত কলকাতায় এসে রেকর্ড করেছিলেন।

১৯২৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি যুক্ত ছিলেন বেতারের সঙ্গে। ১৯২৯ থেকে ১৯৭৫ ( মধ্যে একবছর বাদ ছিল) পর্যন্ত পরিচালনা করেছিলেন ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’। ১৯৩২ সালের মহাষষ্ঠীর দিন প্রভাতে মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার পঙ্কজকুমার মল্লিকের জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পরে অবশ্য এর সম্প্রচারের সময় বদলানো হয়। আজও এই অনুষ্ঠান স্বমহিমায় সম্প্রচারিত হচ্ছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে পঙ্কজ মল্লিকের অবদান অনস্বীকার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন “এই হিসেবে তাঁকেই আমার গুরু বলা যায়।..... রবীন্দ্রসঙ্গীতে নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন পঙ্কজদা তাঁর একার দায়িত্বে”। রাজনৈতিক বিক্ষোভও তিনি সামাল দিয়েছিলেন ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ গান শুনিয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি অনুবাদ করিয়ে সেই গান নিজে গেয়েছেন নানান জায়গায়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি সর্বজনের মাঝে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ কাজে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহও কম ছিল না।

এমন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বকেও অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর প্রাণের অনুষ্ঠান ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেবার ব্যথা তাঁকে বড় কষ্ট দিয়েছিল।

১৯৭৮-র ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘ঘুমের দেশে’ পাড়ি দিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। চিরবিদায় নিলেন সেই মানুষটি যাঁকে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগস্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...