রায়-গিলক্রিস্ট যুদ্ধঃ বিশ্ব ক্রিকেটের এক অজানা দ্বৈরথ

১৯৬১-৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ০-৫-এ হেরে আসার পরে বিসিসিআই চারজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফার্স্ট বোলারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ভারতীয় প্লেয়ারদের তালিম দেওয়ার জন্য। আর রঞ্জি ট্রফি খেলবার জন্যে।  চার্লি স্টেয়ার্স চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন বম্বের হয়ে, রয় গিলক্রিস্টের চুক্তি ছিল হায়দরাবাদের সঙ্গে। লেস্টার কিং এসেছিলেন বাংলার হয়ে খেলার জন্য, এবং চেস্টার ওয়াটসনের টিম ছিল দিল্লী। এই ঘটনা সেই সময়ের।

কানপুরে তখন ভারত চীন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে ফান্ড কালেকশনের জন্যে একটা প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। পঙ্কজ রায় সেই সময়ে ভারতীয় দলে নিয়মিত খেলছেন এবং বেশ নামও করেছেন। বাংলার তরফ থেকে তিনি এবং লেস্টার কিং সেই চ্যারিটি ম্যাচ খেলার আমন্ত্রন পান। সেই সময়ে রঞ্জি ট্রফির খেলাও চলছিল। তারই মাঝে সরকারকে সাহায্য করার জন্যে চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন হয়।

সেই ম্যাচের লাঞ্চ টাইমে সতীর্থদের লেগ পুলিং করছিলেন ফ্ল্যামবয়েন্ট ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। সামনেই ছিল বেঙ্গল বনাম হায়দ্রাবাদ রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। হায়দ্রাবাদের অধিনায়ক এম এল জয়সীমা তখন বিরাট বড় সুপারস্টার। ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার বোম্বের প্রতিনিধিত্ব করতেন। বোম্বে ইতিমধ্যেই রঞ্জি সেমিফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি হঠাৎ জয়সীমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন - " জয় তাহলে বম্বেতে মাঠে দেখা হচ্ছে।" একটু দুরেই চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন পঙ্কজ রাজ এবং লেস্টার কিং। ফারুখের কথাটা খট করে দুজনেরই কানে গিয়ে ধাক্কা মারল। কি বলছে ফারুখ! সেমিফাইনালের আগে তো কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা হবে! আগে তো হায়দ্রাবাদ বেঙ্গলকে হারাক। তারপরে তো বম্বের সাথে সেমিফাইনালের প্রশ্ন। এরপর ইঞ্জিনিয়ার আর জয়সীমা সেমিফাইনাল ম্যাচের খুঁটিনাটি নিয়ে মেতে গেলেন।

পঙ্কজ রায় বরাবরই কম কথার মানুষ ছিলেন কিন্তু লেস্টার কিংয়ের ক্যারিবিয়ান রক্ত গরম হয়ে গেল। বলে উঠলেন - তুমি কি বলতে চাইছো ফারুখ? বেঙ্গল কোনও টিমই নয়? ফারুখ কিং-এর কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করলেন না। জয়সীমার সাথে সেমিফাইনাল নিয়ে কথা বলা চালিয়ে যেতে লাগলেন আর মাঝে মাঝেই আড়চোখে কিং আর পঙ্কজ রায়ের দিকে তাকাতে লাগলেন। লেস্টার কিং এর পক্ষে নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। পঙ্কজের বারণ করা সত্বেও হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা চেয়ার ছেড়ে উঠে ইঞ্জিনিয়ারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন কিং। বললেন - "আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো ফারুক। যতটা সহজ মনে করছো অত সহজ হবে না কিন্তু। মিলিয়ে নিও বাংলাও খেলতে জানে।" ফারুক ইঞ্জিনীয়ারের চোখ তখন কপালে। বললেন - কী! তোমরা হারাবে আবিদ আলি, এম এল জয়সীমা আর আব্বাস আলিংবেগের হায়দ্রাবাদকে? বলি আছেটা কে তোমাদের দলে? কেন? আমাদের শ্যামসুন্দর মিত্র আছে। উত্তর দিলেন কিং।

- ওটা আবার কে? নামই শুনিনি।

- প্রকাশ পোদ্দার আছে।

- হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার ইন্ডিয়া টিমে  টুয়েল্ভথ ম্যান হয়েছিল।

- অম্বর রায় আছে আমাদের।

- আরে ওর মুখ থেকে তো দুধের গন্ধই যায়নি। স্কুল ক্রিকেট খেলুক এখনও।

- আমি নিজে আছি। পঙ্কজ আছে।

- হ্যাঁ, তুমি খানিকটা বল করবে। পঙ্কজ হয়তো কিছুটা লড়াই দেবে। কিন্তু তারপর ? 

- চোয়াল ততক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে লেস্টারের। "তুমি যতটা সহজ ভাবছো ততটা সহজ হবে না কিন্তু...

কিং কথাটা শেষ করতে পারলেন না। একটু দূর থেকে একটা কর্কশ গলা ভেসে এল। "চুপ করো, একদম চুপ! তোমাদের এক একটার মাথা ফাটিয়ে দেবো। মাঠেই মেরে শুইয়ে দেবো"। আসরে নামলেন কিংয়েরই স্বদেশীয় রয় গিলক্রিস্ট। পঙ্কজ  রায়ের দিকে তাকিয়ে রাগে গর গর করছেন রয় গিলক্রিস্ট।

কে এই রয় গিলক্রিস্ট?  খুব বেশি খেলেননি। মাত্র ১৩ টা টেস্ট (৫৭ টি উইকেট) আর ৪৩ টা প্রথমশ্রেনীর ম্যাচের সংক্ষিপ্ত কেরিয়ার। কিন্তু যতটুকু ক্রিকেট খেলেছেন ততটা সময় মৃত্যু আর গিলক্রিস্ট সমার্থক নাম ছিল। বদমেজাজি খুনে বোলার ছিলেন। ব্যাটসম্যানকে আউট করার চেয়ে আহত করে বেশি আনন্দ পেতেন। এর একটা কথা ছিল- বলটা যখন ব্যাটসম্যানের মাথায় গিয়ে আঘাত করে তখন সেই আওয়াজটা আমার কাছে সঙ্গীতের মতোই মধুর লাগে। বল করবার সময়ে ভুলেই যেতেন যে মাঠে আম্পায়ার, অধিনায়ক বলে কিছু আছে আর বোলিং ক্রিজ বলে একটা লাইন আছে।

বোম্বে টেস্টে ২২ গজের বদলে ১৮ গজ অবধি ঢুকে বীমার মেরে ভারতীয় ব্যাটসম্যান কৃপাল সিং এর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধ ? কৃপাল সিং তার আগের তিনটে বলে পরপর তিনটে বাউন্ডারি মেরেছিলেন। এই নিয়ে ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক জেরি আলেকজান্ডার প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে সংযত হতে পরামর্শ দেন। ড্রেসিংরুমে অধিনায়কের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদের পরে গিলক্রিস্ট আলেকজান্ডারকে লক্ষ্য করে ছোড়া উঁচিয়ে ধরে শাসিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

উত্তরাঞ্চলের বিপক্ষে পরের খেলায় কেমব্রিজে পূর্ব-পরিচিত সরজিৎ সিংএর সাথে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে যান। সর্বজিতকে লক্ষ্য করে আবার কুখ্যাত লাইন ক্রস করা বিমার মারেন।

 অধিনায়কের নির্দেশ ধর্তব্যের মধ্যেই না এনে এই আক্রমণ পরিচালনা করেন। মধ্যাহ্নভোজনের বিরতিতে আলেকজান্ডার তার পরিবর্তে অতিরিক্ত খেলোয়াড়কে মাঠে নামান ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেন। দলের মধ্যে সবাই একঘরে করে দেন তাকে। দলের বাদ-বাকী সদস্যরা পাকিস্তান সফরের জন্য প্রস্তুতি নেন। দেশে ফেরার বিষয়ে আলেকজান্ডার তাকে বলেন যে আমরা এখন পাকিস্তানের ফ্লাইট ধরবো, কিন্তু আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানে নয় পরের বিমানে তুমি বাড়ি ফিরে যাবে। এভাবেই মাত্র ২৪ বছর বয়সে তার টেস্ট খেলোয়ার জীবনের অকাল সমাপ্তি ঘটে। এরপর উপার্জনের জন্যে গিলক্রিস্ট ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলতে শুরু করেন। সেখানে ১৯৬৭ সালে স্ত্রী নভেলীনকে নির্যাতন করার অপরাধে জেল খাটেন। রায়দান করার সময়ে বিচারকের উক্তি ছিলো - " এই নরপশু মনে হয় ভুল করে ক্রিকেটার হয়ে গেছে।"

এহেন রয় গিলক্রিস্টের সাথে পঙ্কজ রায়ের একদম সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল। তার কারণও ছিল। ১৯৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিল ইন্ডিয়া ট্যুরে। গিলক্রিস্ট তখন বিশ্বত্রাস। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরেক মূর্তিমান করাল ওয়েস হল। গিলি আর হল জুটির সামনে রান করব না আগে প্রাণে বাঁচব এটাই ব্যাটসম্যানদের কাছে মূল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াত। সারা ভারতের ক্রিকেট প্রেমীদের বুক কাঁপছিল।

এই অবস্থায় শুরু হল বম্বেতে প্রথম টেস্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগে ব্যাট করে তুলল ২২৭ রান। ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই গিলি হলের দাপটে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেল। মাত্র চল্লিশ রানের মধ্যেই ভারত হারাল নরি কন্ট্রাক্টর, বিজয় মঞ্জরেকর , গোলাম গার্ড আর সুভাষ গুপ্তের উইকেট। কিছুটা লড়লেন পঙ্কজ  রায় (১৮) আর অধিনায়ক পলি উমরিগড় (৫৫)। ভারতের ইনিংস শেষ হল ১৫২ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চার উইকেটে ৩২৩ তুলে দান ছেড়ে দিল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক আলেকজান্ডার ভেবেছিলেন গিলক্রিস্ট আর হলের পক্ষে ৩৯৯ রানের লিড যথেষ্ঠ। খেলার বাকি প্রায় দেড় দিন। হাসতে হাসতে জিতে যাবেন। কে কটা উইকেট পাবে তার হিসাব করছিলেন গিলক্রিস্ট আর ওয়েস হল। ভারতের শুরুটাও ভালো হল না। শুরুতেই রান আউট হয়ে গেলেন নরি কন্ট্রাক্টর। এরপরে ১৫৯ রানের মধ্যে ভারত হারাল বিজয় মঞ্জিরেকর, উমরিগড় আর গুপ্তের উইকেট। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দিলেন পঙ্কজ রায়। গিলক্রিস্ট হলের আগুনে বোলিংয়ের সামনে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। করলেন ‘মাত্র’ নব্বই রান, কিন্তু সময় নিলেন পাক্কা সাত ঘন্টা ২৪ মিনিট। শেষ পর্যন্ত ওয়েস হলের নেওয়া একটা বাম্প ক্যাচে নিশ্চিত সেঞ্চুরীর মুখ থেকে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আউট হয়ে যখন ফিরে এলেন তখন আশংকার মেঘ কেটে গেছে। বাকি সময়টা নাদকর্নি সামলে দিলেন।

গিলক্রিস্ট এই ম্যাচের কথা নিজের আত্মজীবনীতেও লিখে গেছেন। বলেছেন – “আমার মনে হয় হতভাগ্য পঙ্কজ এই ইনিংসটার কথা দুঃস্বপ্নে এখনো রাত্রে মনে করে”। দুঃস্বপ্ন এই জন্যেই হয়তো বলেছেন কারণ আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে এসে পঙ্কজ রায় যন্ত্রণায় গায়ের শার্ট খুলতে পারছিলেন না। বলের আঘাত শরীরের দাগড়া দাগড়া কালশিটেগুলোর ওপরে ঘামের সঙ্গে জামাটা সেঁটে গিয়ে অসহনীয় অবস্থা করে দিয়েছিল। পঙ্কজের ওপরে সেই থেকেই গিলির রাগ।

ফিরে আসা যাক আগের কথায়। কানপুরের ড্রেসিংরুমে ডাইনিং টেবিল থেকে একটা কাঁচা ডিম তুলে নিলেন গিলক্রিস্ট। তারপরে ঠক করে সেটা টেবিলের ওপরে ফাটিয়ে দিলেন। ভেঙ্গে যাওয়া খোলা আর গড়ানো কুসুমটার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে পঙ্কজ রায়কে বললেন " এটার দিকে চেয়ে দেখো রায়, মাঠে তোমার মাথার অবস্থাটাও ঠিক এইরকম হবে।" অপমানে পঙ্কজ রায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মুখে নয় এর জবাব দিতে হবে মাঠেই।

শুরু হল বেঙ্গল বনাম হায়দ্রাবাদ রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। চারদিনের ম্যাচ ছিল। এই ম্যাচটায় কিন্তু কিংবদন্তী ভারতীয় ফুটবলার চুনী গোস্বামীও খেলেছিলেন। টসে জিতে ব্যাটিং নিলো বাংলা। বিকাশ চৌধুরী এবং কল্যান মিত্র সুবিধে করতে পারলেন না। পিচের ওপরে আগুন ছোটাতে লাগলেন গিলক্রিস্ট। একদিকে চোয়াল চেপে লড়াই শুরু করলেন ওপেন করতে নামা পঙ্কজ রায়। প্রকাশ পোদ্দারের (৪১) সাথে একটা ভালো পার্টনারশিপ হলো। এরপরে শ্যামসুন্দর মিত্র (৯৮) র ব্যাট থেকেও একটা দুর্দান্ত ইনিংস বেরল। অল্পের জন্যে শতরান ফস্কালেন। অন্যপ্রান্তে তখন গিলি পঙ্কজ লড়াই জমে উঠেছে। সব ধাক্কা সামলে সেঞ্চুরী করলেন পঙ্কজ রায়। ঝকঝকে ১১২ রান করে সেই গিলক্রিস্টের বলেই আউট হলেন। বাংলা প্রথম ইনিংসে তুলল ৩৮৬ রান।

ব্যাট করতে নামল হায়দ্রাবাদ। সাব্বির আর আবিদ আলি শুরু করলেন ধীরে সুস্থে। কিন্তু এইবার চ্যালেঞ্জ ফিরিয়ে দেওয়ার পালা ছিল লেস্টার কিং-এর। সতীর্থ পঙ্কজের লড়াই আর বিপক্ষে গিলক্রিস্টের বোলিং কিংকে তাতিয়ে দিল। হায়দ্রাবাদের ব্যাটসম্যানরা পাল্টা লড়াই দিল। আবিদ আলি(২০), এম এল জয়সীমা (৫৩) এবং আব্বাস আলি বেগ (৬৫) তিন সুপারস্টার রান করলেও সেট হওয়ার পরে সবাই কিংয়ের দুর্দান্ত ফাস্ট বোলিং-এর শিকার হয়ে গেলেন। প্রথম ইনিংসে ৩৬১-র বেশী এগোতে পারল না হায়দ্রাবাদ।

বাংলার দ্বিতীয় ইনিংসে রীতিমতো সংহার মুর্তি ধরলেন রয় গিলক্রিস্ট। বিকাশ চৌধুরী, প্রকাশ পোদ্দার, পলাশ নন্দী কেউই দাঁড়াতে পারলেন না গিলির সামনে। এমনকি আউট হয়ে গেলেন শ্যামসুন্দর মিত্রও। চুনী গোস্বামী শূন্য রানে আউট হওয়ার পরে হায়দ্রাবাদ যখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। ঠিক তখনই অম্বর রায়কে(৪৪) সঙ্গে নিয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করলেন ওপেনিংয়ে নামা সেই পঙ্কজ। দুজনের ভালো পার্টনারশিপ হল। মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে দেখে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেন গিলক্রিস্ট।

তখনকার দিনে ক্রিকেটিয় প্রতিরক্ষার সাজ সরঞ্জাম আজকের মতো এতো উন্নত ছিল না। সুরক্ষা বলতে কলাপাতার মতো নরম প্যাড যা দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্রিকেটেও এখন ব্রাত্য হয়ে যাবে। পাতলা গ্লাভস। হেলমেট, চেস্টগার্ড, আর্মগার্ডের কোনো বালাই ছিল না। স্টাম্প ক্যামেরা ছিল মঙ্গল গ্রহের বস্তু। এরওপরে নো বল ঠাহর করার উপায় ছিল না। ওভার পিছু বাউন্সারের কোনো রেস্ট্রিকশন ছিল না। ছ'টা বলই বোলার বাউন্সার দিতে পারত। এর সঙ্গে ছিল বর্তমানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া ডেলিভারি ‘বিমার’। যেটা সরাসরি ব্যাটসম্যানের মুখ অথবা মাথা লক্ষ্য করে ফুলটসের মতো ছুঁড়ে দিতে পারতেন বোলার।

সমস্ত ক্রিকেটীয় এথিক্স এবং নিয়মকে দু’পায়ে মাড়িয়ে বডিলাইন বোলিং শুরু করলেন গিলক্রিস্ট। শোনা যায় বোলিং ক্রিজের লাইন থেকে একহাত পা বাড়িয়ে পঙ্কজ রায়ের মাথা আর মুখ টার্গেট করে বল ছুঁড়ছিলেন গিলি। অম্বর রায় আউট হওয়ার পরে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়েও লড়াই জারি রেখেছিলেন পঙ্কজ রায়। দ্বিতীয় ইনিংসেও আবার সেঞ্চুরী করেছিলেন। এইবার ওনার ব্যাট থেকে বেরিয়েছিলো ১১৮ রান। এরপরে লেস্টার কিং লোয়ার অর্ডারে নেমে ৩২টা মূল্যবান রান দলকে দেওয়ায় বাংলার দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হল ২৮০ রানে।

দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০৫ রানের টার্গেট পেলো হায়দ্রাবাদ। এইবার দুরন্ত বল করলেন দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। চার উইকেট নিলেন। ২৬ ওভারে ৮ উইকেটে ১২১ রানের বেশী এগোতে পারলো না হায়দ্রাবাদ। সেইসময়ের নিয়মে বাংলাকে ১৮৪ রানে জয়ী ঘোষণা করা হল। গিলক্রিস্ট ম্যাচ থেকে তুলেছিলেন নটি উইকেট।

বাংলার ক্রিকেট নিয়ে ফারুখ ইঞ্জিনীয়ার, এম এল জয়সীমার হাসি মস্করার উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন পঙ্কজ রায়। ছয়শোর ওপরে রান করে সেই রঞ্জি সিজনের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন। পঙ্কজ রায় বনাম গিলক্রিস্ট লড়াই ক্রিকেটের অন্যতম রূপকথাগুলোর পর্যায়ভুক্ত।

১৯৫২ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি , চেন্নাইয়ে কর্পোরেশন স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বার টেস্ট জিতেছিল ভারতীয় ক্রিকেট টিম৷ এক ইনিংস ও ৮ রানে৷ ওপেন করতে নেমে সেই টেস্টে ১১১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন পঙ্কজ৷ টিমে ছিলেন আর এক বঙ্গসন্তান প্রবীর সেন৷

সর্বভারতীয় অনেক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে মুস্তাক আলি , বিজয় হাজারে , বিজয় মার্চেন্ট, পলি উমরিগড় , দাত্তু ফাদকরদের নামে ট্রফি আছে৷ দেশ তো দূরের কথা, নিজের বাংলাতেও পঙ্কজ রায়ের নামে নেই কোনও টুর্নামেন্ট৷ সম্প্রতি ইডেনের একটি স্ট্যান্ড পঙ্কজ রায়ের নামে করা হয়েছে৷ ইডেনের বাইরের দেওয়ালে রয়েছে তাঁর ছবি৷ ৪৩ টেস্টে পাঁচটি সেঞ্চুরিসহ ২৪৪২ রানের মালিকের সম্মানে শুধু এইটুকুই! আর কিছু করা যেতো হয়তো। প্রশ্ন থেকেই যায়...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...