আগুনপাখি শুভঙ্কর

ভারতের প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্রগুলির অন্যতম একটি হল তবলা। যা ছাড়া সঙ্গীত অসম্পূর্ণ থেকে যায়, অথচ এই তবলাই দীর্ঘদিন সঙ্গীতের পার্শ্ববর্তী একটি অনুষঙ্গ হয়েই থেকে গিয়েছে। আজ তবলা এক নিজস্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে, তবলাকে তার নিজস্ব ঐশ্বর্যে পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্য কারিগরদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী হলেন, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

 

তবলা শব্দটা শুনলেই আমাদের প্রথমে মনে পড়ে জাকির হুসেনের কথা।বিশ্ববন্দিত তবলা শিল্পী আর কে-ই বা! কিন্তু সেই জাকির হুসেন যদি কোনও সমকালীন শিল্পীকে স্বীকৃতি দেন! যদি সেই শিল্পীকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যান তাঁর বাবা প্রয়াত কিংবদন্তি উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ সাহিবের স্মৃতিতে আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে? কিংবা অত্যন্ত ব্যস্ত সেই জাকির হুসেনই যদি স্বেচ্ছায় নিজেই চলে আসেন শুভঙ্করের মা কাজলরেখা দেবীর স্মৃতিতে আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে একক তবলা পরিবেশনে? তখন সেই শিল্পী আর নিছক তবলিয়া হয়ে থাকেন না। হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিল্পী।

 

tabla 7

 

ফারুখাবাদ ঘরানার উস্তাদ কেরামাতুল্লা খাঁ সাহিবের শিষ্য পণ্ডিত স্বপন শিবের ছাত্র শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃতার্থেই সার্থক শিল্পী। কোনো খ্যাতনামা সঙ্গীত শিল্পী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়নি। তবুও ছোট থেকেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন তবলাকে। মাত্র ৬ বছর বয়সে তবলায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। তারপর একটু একটু করে অনুশীলন নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক প্রকৃত শিল্পী।

 

মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, উস্তাদ রশিদ খাঁয়ের মতো শিল্পীদের সঙ্গেও। এছাড়াও ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের মতো মঞ্চে একক আসরেও তবলা শুনিয়েছেন তিনি। মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। বিশ্বের এমন কোনও বড় শিল্পী নেই, যাঁর সঙ্গে শুভঙ্কর সঙ্গত করেননি। একই সঙ্গে বিশ্বের তাবড় তাবড় শহরে তাঁর একক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়েছে।

 


সেই ছয় বছর বয়সী শুভঙ্করের শিল্পী হয়ে ওঠার যাত্রাপথে বাধা ছিল, কিন্তু পাহাড়প্রমাণ সব বাধাকে তুচ্ছ প্রমাণ করে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। পাশে পেয়েছিলেন মাকে। তাঁর জীবনের লড়াই আর পাঁচজন বাঙালির থেকে খানিক বেশিই; কারণ, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা কাজলরেখা দেবী ছিলেন আশৈশব পোলিয়ো আক্রান্ত। দু'হাত এবং দু'পা মাটিতে রেখেই চলাফেরা করতে হত তাঁকে।

tabla9

একবার এক সাংবাদপত্রে, শুভঙ্কর তাঁর মায়ের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, 'মা বলত, আমি তো আর পাঁচটা মায়ের মতো নই। তাই তুইও আর পাঁচটা ছেলের মতো তৈরি হবি না।' সত্যিই আমার মা আর পাঁচটা মায়ের মতো নন। জন্ম থেকেই দেখছি, আমার মা হাতে-পায়ে একসঙ্গে এগিয়ে চলেন। ইংরেজি ওই 'ডিস-এইবল' শব্দটা মায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলেও মায়ের মতো আলোকশক্তি তেমন করে আর চোখে পড়েনি আমার। মা আশৈশব পোলিও আক্রান্ত। তবুও এমন কাজ ছিল না, যা তিনি করেননি বা করতে পারেননি।

 


এমন মা ছিলেন বলেই হয়তো প্রকৃতি শিল্পী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন শুভঙ্কর। সেই মায়ের ছেলে বলেই, হয়ত শুভঙ্কর বিশ্বের তাবড় তাবড় শিল্পীর কুর্নিশ আদায় করে নিলেও, নিজের অতীতকে ভুলে যাননি। যতই অকিঞ্চিৎকর শিল্পী হোক না কেন, শুভঙ্করের কাছে পৌঁছলেই সাহায্য পাবেন তিনি, পাবেন সমস্যার সমাধান। আইএসসি পরীক্ষা না দিয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ন'মাসের জন্যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন শুভঙ্কর। মা সেই সময়ও তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মা নিজে বলেছিলেন, ‘এ রকম মায়ের জন্য আমার কিছু হল না’, এই চিন্তা যেন কখনওই তাঁর পথ চলাকে আটকে না দেয়।' আগুনে পুড়েছেন শিল্পীর মা, ছেলেকেও আগুনে পুড়তে শিখিয়েছেন। আগুনে না পুড়লে যে খাঁটি সোনা হয় না!

tabla10

মায়ের স্মৃতিতেই শুভঙ্কর তৈরি করছিলেন ‘কাজলরেখা ফাউন্ডেশন’। বিশেষ ভাবে সক্ষম গুণী শিল্পীদের সাহায্য করে শুভঙ্করের এই সংস্থা। এই সংস্থার বার্ষিক অনুষ্ঠানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এমন কোনও শিল্পী ছিলেন না, যিনি আসেননি। শুভঙ্কর নিজে ভাল গান করতেন, তাঁর গানের একাধিক রেকর্ডিংও রয়েছে। দেশে বিদেশে জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ছাত্রেরা, যাঁদের মধ্যে পুত্র আর্চিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও পড়েন।

 

এবার মানুষ শুভঙ্করের কথা, একবার শহরে এক অনুষ্ঠানের পরে এক তরুণ সাংবাদিক শুভঙ্করকে বললেন, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সাক্ষাৎকার প্রয়োজন। যেই বলা সেই কাজ, ভিড় ঠেলে গ্রিনরুমে পৌঁছে হরিপ্রসাদের কানে কানে কিছু বলেই ওই নবীন সাংবাদিককে শুভঙ্কর বসিয়ে দিলেন বাঁশির জীবন্ত কিংবদন্তির সামনে। তারপর সাংবাদিককে আত্মবিশ্বাস জোগানোর অসামান্য প্রদর্শন, একটু হাসি, যার অর্থ, এবার তুমি লড়ে নাও।বেশ কয়েক বছর আগের কথা, শহরের একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। সেবারেও তাঁর সঙ্গে বাজিয়েছিলেন শুভঙ্কর।

 

পণ্ডিতজীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, শহরে বহু গুণী তবলিয়া রয়েছেন, তা হলে আপনি এলেই শুভঙ্করের ডাক পড়ে কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'শুভঙ্কর থাকলে মনে হয়, বাড়িতে বসে রেওয়াজ করছি। এতটা কমফর্টেবল অন্য কোনও তবলিয়ার সঙ্গে নই। এমনও হয়েছে, আমি বা রাহুল (অর্থাৎ শিবকুমারের পুত্র) কোনও শহরে গিয়েছি। শুভঙ্করও এসেছে। বিমান দেরিতে পৌঁছেছে। আমাদের দেখা হয়েছে একেবারে স্টেজে। গ্রিনরুমে নয়। কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি।’ শুভঙ্করের সঙ্গে এমনটাই আত্মিক সম্পর্ক ছিল শিল্পীদের।

 

tabla 8


কিংবদন্তি শিল্পী বাঁশির প্রবাদপুরুষ হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া কলকাতায় এলেও ডাক পড়ত সেই শুভঙ্করের। হরিপ্রসাদ নজরুল মঞ্চে শেষ যেবার অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানেও তাঁর সঙ্গতে ছিলেন শুভঙ্কর।যাঁর নিত্যদিন ওঠাবসা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তিদের সঙ্গে, সেই মানুষটি নিজে কিন্তু এক্কেবারে মাটির মানুষই ছিলেন।

 


বছর কয়েক আগের কথা বন্ধু এবং শুভঙ্করের তদানিন্তন সহকর্মী অনির্বাণ ভট্টাচার্যের বিয়ে। অনির্বাণ গান শিখেছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে, তখনও তাঁর স্ট্রাগেল চলছে। সাংবাদিকতা ছেড়ে গানকে কেরিয়ার হিসাবে বেছে নেওয়ার লড়াই করছেন তিনি। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে শুভঙ্করও হাজির।অনির্বাণ তাঁর বন্ধুটিকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তাই শুভঙ্কর আর সেদিন কোনও প্রোগ্রাম রাখেননি। হাজির হয়েছিলেন বন্ধুত্ব রক্ষা করতে। নিমন্ত্রিতের তালিকায় অনেকেই ছিলেন,কেউ কেউ এসেওছিলেন। শুভঙ্কর ছিলেন অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যন্ত। সব মিটে যাওয়ার পরেই ফিরেছিলেন সেদিন।

 


এইভাবে মানুষ শুভঙ্কর সব সময়েই ছাপিয়ে গিয়েছেন শিল্পী শুভঙ্করকে। প্রকৃত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন বলেই, শুভঙ্কর পেরেছিলেন সেলেব্রিটি ইমেজ ভেঙে তথাকথিত আজকের সমাজে ব্যতিক্রমী এক মানুষ হয়ে উঠতে। যন্ত্রসঙ্গীতের এই কিংবদন্তিকেই কেড়ে নিল করোনা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...