বঙ্গের গৌরব মারাঠা বর্গীদের এই প্রাসাদ

             বাংলায় মারাঠা বর্গীদের তান্ডবের ইতিহাস ও নবাব আলীবর্দীর উদ্যোগে তাদের চরম পরিণতি ও বিতাড়নের ঘটনা প্রায় সকলেরই জানা। যদিও বর্গিদের সবাই কিন্তু তখন বাংলা ছেড়ে চলে যাননি। বর্গি সেনাবাহিনীর কেউ কেউ  বিত্তশালী হয়ে থেকে যান এই বাংলাতে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে আপন করে সেই  সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকেন তাঁরা। তাঁদেরই অন্যতম ছিলেন কুন্দ্রারা - যাদের হাত ধরেই তৈরী হয়েছিলো আজকের  হুগলি জেলার ইটাচুনায় বিশাল প্রাসাদ। রাধামাধব কুন্দ্রা বাকিদের মতো বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে চলে না গিয়ে লুঠের ধনসম্পত্তি এবং চাষাবাদ উপার্জিত অর্থ থেকে  ইটাচুনা গ্রামে এক স্থায়ী জমিদারি গড়ে তোলেন।

            বঙ্গ সংস্কৃতির এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে আত্মীকরণ। আর তার ফলেই কালক্রমে কুন্দ্রা পরিবার হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর বাঙালি। বাঙালিয়ানার মহিমায় ‘কুন্দ্রা’ পদবি উচ্চারণ দোষে দুষ্ট হয়ে গোত্র পাল্টে হয়ে গেছে ‘কুণ্ডু’। এই নামের পরিবর্তন শুধু এদের ক্ষেত্রেই নয়, বঙ্গ ইতিহাস এমন আরো অনেক ঘটনার  সাক্ষী। এই পরিবারের সাফল্যরাম কুণ্ডু প্রায় ২০ বিঘা জমির উপর ১৭৬৬ সালে তৈরি করিয়েছিলেন এই বিশাল রাজবাড়ি। এরপর নারায়ণ কুণ্ডু এবং তারও বেশ কিছু পরে বিজয়নারায়ণ কুণ্ডু জমিদার থাকার সময়ে বাড়ির কাঠামোকে খানিক পরিবর্তন করে নতুন রূপ দেওয়া হয়। তবে পদবি পাল্টালেও  ইতিহাস তাদের বর্গি পরিচয়কে পুরোপুরি বিস্মৃত করতে পারে নি। কারণ ইটাচুনার রাজপ্রাসাদকে এখনও স্থানীয় মানুষ ‘বর্গিডাঙা’ বলেই ডাকে। বর্গিদের তৈরি করা রাজবাড়ি কি না!

             এখন এই প্রাসাদ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্ম এখন বাড়িটিকে নতুন করে সাজিয়েছেন। পর্যটকদের জন্য রয়েছে  রাত্রিযাপনের দারুণ বন্দোবস্ত। সঙ্গে আছে রাজকীয় খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। রাজবাড়ির নিজস্ব কাঁসার থালাবাসনে পরিবেশিত হয় একেবারে খাঁটি বাঙালি রান্না। ঘরগুলির বিশেষত্ব হলো সেগুলো বড়োমা, ঠাকুমা, মেজোমা, পিসি এইভাবে পর্যায়ক্রমে নামাঙ্কিত - যাতে বেশ নতুনত্বের ছোঁয়া আছে, তবে আসবাবে কিন্তু অতীতের রাজকীয় ছাপ স্পষ্ট এবং যথার্থ যত্নে সজ্জিত। শুধু পর্যটনকেন্দ্র তো বটেই, শুটিং স্পট হিসেবেও এই রাজবাড়ি বেশ নাম আছে। শুধু রাজবাড়ির রাজকীয়তা নয় চাইলে কিছুদিনের জন্য গ্রাম্য মাটির বাড়ির অভিজ্ঞতাও  সংগ্রহ করতে পারেন - সব ব্যবস্থাই অতি চমৎকার। সম্প্রতি  ‘লুটেরা’ সিনেমা ও  বেশ কিছু বেশ কিছু বাংলা ছবির শুটিং এই রাজবাড়িতে হয়েছে।

                 ইটাচুনার রাজবাড়ি যেতে হলে সড়কপথে গাড়ি নিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বসিপুর, হালুসাই পেরিয়ে মিনিট দশেক গেলেই প্রাসাদ নজরে পড়বে। আর যদি রেলপথে যেতে চান, তাহলে বর্ধমানগামী যে কোনো মেইন লাইনের ট্রেন ধরতে হবে। এছাড়া হাওড়া থেকে মেমারি-পান্ডুয়া লোকালেও যাওয়া যায়। ব্যান্ডেলের পর আরও কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে খন্যান আসবে। খন্যান স্টেশন থেকে ভ্যান অথবা অটো কিংবা রিক্সায় ইটাচুনা রাজবাড়ি পৌঁছতে লাগবে মোটামুটি দশ মিনিট। ঘোরার জন্য আলাদা করে বুকিং এর প্রয়োজন পড়ে না তবে রাত্রি যাপনের জন্য বেশ কিছু আগে থেকেই বুকিং করা প্রয়োজন। সময় করে  ঘুরে আসতেই পারেন ঘরের কাছে এই বর্গীদের স্মৃতিবিজড়িত এই রাজপ্রাসাদে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...