গোবর্ধন আশ। নামটি শুনলেই একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে পড়ে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, শিল্পী গোবর্ধন আশের ছবির একটি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম বিড়লা একাডেমিতে, তখন তিনি প্রয়াত। বেশ কিছু ছবি দেখে যখন মন ভরে গেছে, ঘুরতে ঘুরতে তখনই চোখ যায় কিছু খুব ছোট(সম্ভবত দৈর্ঘ্য প্রস্থ মিলিয়ে ৫/৬ ইঞ্চির বেশি বড় নয়) আকারের ল্যান্ডস্কেপ এর দিকে, খুব সাধারণ কাগজে জলরঙে আঁকা খুব সহজ সরল গ্রামবাংলার ছবি।সরল ছবিগুলির আবেদন এত তীব্র যে, তা দর্শককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে।
কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলাম ছবিগুলো আসলে পুরোনো বাংলা ক্যালেন্ডার, যেগুলো আগে হালখাতায় পাওয়া যেত,তার নিচের অংশগুলো যেখানে তারিখ ছাপা থাকতো, সেই কাগজে আঁকা, অনেকেই হয়তো জানেন,ঐ তারিখ ছাপা অংশগুলো ছাপা হতো অতি সাধারণ সস্তা নিউজপ্রিন্টের মতো কাগজে। অনেক ছবি ভালো করে দেখলে দেখাও যাচ্ছিল উল্টো বাংলা তারিখ। এ
মন সব প্রায় ফেলনা উপাদান দিয়ে মাস্টারপিস ছবি হয়ে উঠতে পারে,তা আমরা ধারণাও করতে পারিনা। একটি ছবিকে ছবি হয়ে উঠতে, কালোত্তীর্ণ শিল্প হয়ে উঠতে কী কী লাগে, সেদিন সব গুলিয়ে গিয়েছিল। আমরা কত কিছু নিয়ে ভাবি, শুধু ছবিটাই নিয়েই ভাবিনা।
১৯০৭ সালের ৫ই আগস্ট হুগলী জেলার বেগমপুরের প্রখ্যাত আশ পরিবারে জন্ম শিল্পী গোবর্ধন আশ এর। ছোটোবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি তীব্র অনুরাগ।
একবার এক বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন বেনারসে,যদি কোনোভাবে ছবি আঁকা শেখা যায়! এমনই আগ্রহ শিল্পের প্রতি।
যাইহোক, এই অদম্য ইচ্ছেশক্তির জোরেই পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত একটি পরিবার থেকে উঠে আসা গোবর্ধন আশ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন। গুরু হিসাবে পেলেন কিংবদন্তি শিল্পী অতুল বসুকে। শিখলেন তেলরঙের কৃৎকৌশল। মনোযোগী ছাত্র হিসেবে তৈলচিত্রের কিংবদন্তী শিল্পী অতুল বসুর সঙ্গে কাজ করবার একমাত্র বিরল সুযোগ লাভ করেছিলেন গোবর্ধন আশ। কাছ থেকে দেখেছিলেন গুরুর নিজস্ব টেকনিক, যা শিল্পীকে পরবর্তীকালে তেলরঙে দক্ষ প্রতিকৃতি শিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল।
তাঁর আগের তেলরঙের রচনা বিশেষত পোর্ট্রেটগুলি দেখলেই অতুল বসু ঘরানার ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
পরবর্তী সময়ে মাদ্রাজে শিল্পী ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কাছে শিল্পশিক্ষা শিল্পীর শিল্পদর্শনের উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। আচার্য্য যামিনী রায়ের সাহচর্য্য পেয়েছিলেন। তাঁর কাছেই শেখেন দেশি রঙের প্রয়োগ।
এখান থেকেই কি বাঁক ঘুরে যায় শিল্পীর কাজের ধারায়? বাস্তববাদী ধারায় তিনি যে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন তা তাঁর ঐ পর্বের কাজ দেখলে ধারণা করা যায়। তবে জীবনের এক বাঁকে তাঁর ছবির রূপবদল ঘটতে থাকে। মূর্ত ধীরে ধীরে বাঁক নিতে থাকে বিমূর্তের পথে। এক্ষেত্রে নিবিড় প্রকৃতিপাঠ এবং তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ নিঃসন্দেহে এই বোধকে সমৃদ্ধ করেছিল। প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আগেই,এরপর তিনি প্রকৃতি ও মানুষের আটপৌরে জীবনের দলিল ধরে রাখতে থাকেন তার সৃষ্টিতে।
এই পর্ব থেকে তাঁর ছবির ভাষা হয়ে উঠতে থাকে আরও হৃদয়গ্রাহী। ছবির প্রকাশভঙ্গি হয়ে ওঠে আরও সরল, মাটির কাছাকাছি,যা তার চরিত্রের অনুগত।
সারাজীবন সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। ১৯৪২-এ মন্বন্তরের সময় তাঁর চিত্রিত শিল্পকর্ম সময়ের দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়।
ছবির ক্ষেত্রে গতানুগতিকতার পরিপন্থী বলিষ্ঠ মানসিকতার নির্ভীক পদচারণা ছিল তার সহজাত, আর ছিল নিরন্তর নিবিড় সাধনা। জীবনের প্রান্তভাগ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ঈশ্বরের আরাধনার মতোকরে ছবির অনুধ্যান করে গেছেন।
সেই চর্চায় রঙই হয়ে উঠেছে প্রধান। শিল্পী যেন অবগাহন করেছেন রঙের সমুদ্রে। আস্বাদন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন রঙের ধর্ম, আবেদন। গভীর জীবনবোধের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন রঙের ভাষায়।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর শিল্পচর্চা অব্যাহত ছিল। দেশে বিদেশে অসংখ্য প্রদর্শনী, পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন। পেয়েছেন শিল্পরসিকদের অফুরন্ত ভালোবাসা ।
আজীবন জন্মস্থান বেগমপুরের নিবিড় প্রকৃতিপাঠ আত্মস্থ করে ছবিতে তার নান্দনিক সৌন্দর্যের রূপ সংস্থান করে গেছেন জীবনবোধের শিল্পী গোবর্ধন আশ।