যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এবছর পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চেন্নাইয়ের চিকিত্সক ডা. রবি কানন। কখনও কর্তব্যের অবহেলা করেননি। কোনও পরিস্থিতিতেই নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি।
২০০৭ সালে সিনিয়র সার্জিকাল অনকোলজিস্ট ডা. কাননের ডাক পড়ে অসমে, যেখানে বন্যা ও বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রায়ই ঘটে থাকে। তবু কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই অসমেই পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। আর যাওয়ার পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই অসমের প্রতি তাঁর ধারণা বদলে গিয়েছিল।
এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় তেরোটা বছর। আর এতগুলো বছরের প্রত্যেকটা দিন তিনি নিজেকে উত্সর্গ করেছেন মানুষের সেবায়। শুধু কি তাই, গরিব রোগীদের বাড়ির দরজায় দরজায় পৌঁছে গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। রোগীর দেখভাল থেকে শুরু করে কম খরচে চিকিত্সা-সবটাই তিনি সম্ভব করতে পেরেছেন। আর তাঁর এতগুলো বছরের এই অক্লান্ত প্রচেষ্টার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করা হচ্ছে।
শীলচরের কাচার ক্যানসার হাসপাতাল থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই সেখানে গিয়েছিলেন ডা. রবি কানন। সেখানে যাওয়ার পর শুরু হল এক অন্য লড়াই। শুধু কি ডা. রবি কানন, স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীও যোগ দিলেন মানুষের সেবায়। স্বামী যখন মানুষের চিকিৎসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন, তখন ডা. রবি কাননের সহধর্মিণী ব্যস্ত থাকতেন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায়। খুব তাড়াতাড়িই তাঁরা বুঝতে পারলেন এই জায়গা ছেড়ে তাঁদের আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ, চেন্নাইয়ে নিজের প্র্যাক্টিস বন্ধ করে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন তাঁরা শীলচরে। তাঁর স্ত্রী সীতাও চাকরি ছেড়ে নিজেকে নিয়োগ করলেন সমাজসেবায়।
শুধু চিকিৎসাই নয়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ডা. রবি কানন বুঝতে পেরেছিলেন, অধিকাংশ মানুষই দারিদ্রের মধ্যে বাস করেন, তাই তাঁদের চিকিৎসা খরচ কমানো থেকে শুরু করে বিনামূল্যে ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে যাঁদের ক্যানসার ধরা পড়্ তাঁদের অধিকাংশই চিকিৎসা করাতে আসেন না, এটাও তিনি দেখেছিলেন। অন্যদিকে হাসপাতালে একজন রোগীর সঙ্গে তাঁর পরিবারের একজনকে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে থাকলে রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালমুখী হতেন না। তাই এই সমস্যা মেটাতে এবং রোগীকে চিকিৎসার জন্য রাজি করাতে তিনি হাসপাতালেই রোগীর পরিজন, যিনি থাকবেন তাঁর জন্য কাজের ব্যবস্থা করলেন। সঙ্গে বেতনেরও ব্যবস্থা হল।
এখানেই শেষ ভাবলে ভুল হবে। রোগীদের ফলোআপের দিন মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সমাজকর্মীদের বিনামূল্যে মোবাইল ফোন দেওয়া হত, যাতে তাঁরা রোগীদের সেই ফলোআপের দিন মনে করিয়ে দিতে পারেন। যেসব রোগীরা চিকিৎসার জন্য কোনও অর্থ দিতে পারতেন না বলে ফলোআপের জন্য যোগাযোগ করতেন না, তাঁদের জন্য বাড়িতে পৌঁছে যেত মেডিকাল টিম। ডা. রবি কানন বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে যে অর্থ পুরস্কার পান, তাও গরিবদের চিকিৎসায় ব্যয় করেন।
শীলচরের ক্যানসার চিকিত্সায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন এই ডা. রবি কানন। এই অসাধারণ মানুষটির আরও একটি দিক রয়েছে। এতো কিছুর মধ্যেও তিনি নিজের মেন্টরকে ভোলেননি। আজও তিনি তাঁর মেন্টর ডা. শান্তাকে নিয়মিত ফোন করে তাঁর কাছে আসা বিভিন্ন রোগীকে নিয়ে আলোচনা করেন, মেন্টরের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নেন।