"আগেকার দিনে ছবি ধীরে-ধীরে, পর্যায় মেনে, সম্পূর্ণতার দিকে এগোত। প্রতিদিনই তাতে নতুন কিছু যোগ হত। ছবি হয়ে দাঁড়াত নানা কিছুর যোগফল। আমার ক্ষেত্রে, ছবি হল ধ্বংসের যোগফল। আমি একটা ছবি আঁকি- তার পর সেটাকে ধ্বংস করি। শেষ পর্যন্ত, যদিও কিছুই হারায় না। এক জায়গা থেকে তুলে-নেওয়া লাল, অন্য কোথাও গিয়ে ঠিক উদিত হয়।" - এই হল পাবলো পিকাসো'র শিল্পের ধ্বংস ও বিনির্মান।
ধ্বংস-বিনির্মান-চারু-কারু'র এই স্পেনীয় কারিগর বিংশ শতাব্দীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সারা বিশ্বে। তাঁর কাজের মতই লাগাম ছাড়া তাঁর নাম। 'পাবলো পিকাসো' নামে পরিচিত হলেও, ২৩ টি শব্দ নিয়ে গঠিত স্পেনের মালাগা শহরে জন্মগ্রহণকারী এই বিশ্বনন্দিত শিল্পীর পুরো নাম- পাবলো দিয়েগো খোসে ফ্রান্সিসকো দে পাউলা খোয়ান নেপমুসেনো মারিয়া দে লস রেমেদিওস সিপ্রিয়ানো দে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ মার্টির পাট্রিসিও ক্লিতো রুইজ ই পিকাসো। নামের যেখানে শুরু আর যেখানে শেষ সেইটুকুই তাঁর সহজ পরিচয় হিসেবে উঠে এসেছে কিন্তু ব্যক্তিজীবনের শুরু আর শেষের ভিতরে তিনি যা যা কাজ করেছেন, সবকাজেই সবসময় উচ্চারিত হতে পেরেছে তাঁর প্রকৃত নামের সুদীর্ঘ স্নায়ুবিক ক্ষরণ।
"ছবি মোটেই আগে থেকে ভেবে ঠিক করে রাখার জিনিশ নয়। কাজ করার সময়ে চিন্তার সূত্র ধরে তা বদলায়। শেষ হওয়ার পরেও বদলায়, যে দেখছে তার মনের অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাতে থাকে। যে-কোন জীবন্ত প্রাণীর মতো ছবিরও একটা জীবন আছে, প্রতি দিন আমাদের জীবনে বাধ্যতামূলক পরিবর্তনের মতো সে-ও পাল্টায়। এ তো স্বাভাবিক, কারণ ছবির দিকে কেউ দেখলে তবেই সে বাঁচে।" -চিরাচরিত ভাবনাকে নসাৎ করে এভাবেই শিল্পের সমসাময়িকতা এবং স্বকীয়তার বিনির্মান করেছিলেন তিনি।
বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ভাস্কর, প্রিন্টমেকার, মৃৎশিল্পী, মঞ্চ নকশাকারী, কবি এবং নাট্যকার। বিভিন্ন যুগে সময়ের প্রয়োজনেই আনতে হয়েছে 'রেঁনেসা' বা নবজাগরণ, তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের নবজাগরনের একজন পথিকৃৎ। কিউবিজম আর্ট আন্দোলনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি – যা ইউরোপে চিত্র এবং ভাস্কর্যশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তাঁর অতিজনপ্রিয়তা পাওয়া ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম-
থ্রি মিউজিশিয়ানস (Three Musicians):
এই ছবিটির দুইটি ভার্সন রয়েছে। ছবি দুটোর আঁকা শেষও করেন একইসাথে, ১৯২১ সালে। এর একটি ছবি আছে নিউইয়র্কে এবং অন্যটি আছে ফিলাডেলফিয়াতে।
দুটো ছবিতেই যে তিন ক্যারেকটারকে দেখা যায়, সেই তিনজনকে যথাক্রমে পাবলো পিকাসো, গুইলামে অ্যাপোলিনাইরে এবং ম্যাক্স জ্যাকব এর প্রতীকীরূপ বলেই বিশ্বাস করা হয়। 'থ্রি মিউজিশিয়ানস' ছবিটি সিন্থেটিক কিউবিজম এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি।
দ্য ওল্ড গিটারিস্ট (The Old Guitarist):
ছবিটি আঁকেন ১৯০১ – ১৯০৪ সালের মধ্যে, যে সময় কালকে বলা হয় 'ব্লু পিরিয়ড'। ছবিটি তিনি আঁকেন দারিদ্র্যের সঙ্গে তার সংগ্রামের এবং তার বন্ধু কাসাগেমাস এর আত্মহত্যার উপর ভিত্তি করে।
গের্নিকা বা গুয়ের্নিকা (Guernica):
পাবলো পিকাসোর সবচেয়ে সেরা এবং বিখ্যাত চিত্রকর্ম হিসেবে ধরা হয়- গের্নিকা (Guernica)। এই 'গের্নিকা' নামটি এসেছে স্পেনের একটি শহরের নাম থেকে। ১৯৩৭ সালের ২৬শে এপ্রিল, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়, জার্মান নাজি এবং ফ্যাসিস্ট ইটালিয়ানরা স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদীদের অনুরোধে এখানে বোমাবর্ষণ করে। আর পিকাসো গের্নিকাতে সেই বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে তার এই মাস্টারপিস তৈরি করেন। এরফলে বিশ্বের সবার নজর পড়ে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের উপর। আর তাই গের্নিকাকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী 'অ্যান্টি-ওয়ার' চিত্রকর্ম বলে মনে করা হয়।
দ্য উইপিং ওম্যান (ক্রন্দনরত নারী – The Weeping Woman) :
পাবলো পিকাসোর সবচেয়ে সেরা চিত্রকর্ম গের্নিকাতে তিনি একটি ক্রন্দনরত নারীর চিত্র আঁকেন যে তার মৃত শিশুকে ধরে রেখেছে। আর এরপর তিনি ঐ চরিত্রের উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু ছবি আঁকেন। যার চরম পরিণতি দেখা যায় এই 'দ্য উইপিং ওম্যান' (ক্রন্দনরত নারী – The Weeping Woman) ছবিটিতে যা 'উইপিং ওম্যান' সিরিজের সর্বশেষ ছবি।
লেস ডেমোঁয়সেলেস ডি’এভিগনন (দ্য ইয়ং লেডিস অব এভিগনন – Les Demoiselles d’Avignon):
পাবলো পিকাসোর লেস ডেমোঁয়সেলেস ডি’এভিগনন ছবিটিকে ২০ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী ছবি হিসেবে ধরা হয় যেহেতু এটি কিউবিজম আর্ট এবং মডার্ন আর্ট উভয় ক্ষেত্রেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। প্রথমে এই ছবিটির নাম ছিল ‘লে বোরদেল ডি’ডি’এভিগনন (দ্য ব্রোথেল অব এভিগনন – The Brothel of Avignon)।
লেস ডেমোঁয়সেলেস ডি’এভিগনন (দ্য ইয়ং লেডিস অব এভিগনন – Les Demoiselles d’Avignon) ছবিতে দেখা যায় ৫ জন নগ্ন পতিতাকে। পাবলো ছবিটি এঁকেছেন ১৯০৭ সালে, কৌণিক এবং অসংযুক্ত দেহের গঠনে। প্রতিটি চরিত্রই একটি বিরোধপূর্ণ পদ্ধতিতে চিত্রিত করা হয়।
পিকাসোর আরো কিছু ছবি: লে রিভ (দ্য ড্রিম), ল্যা মুল্যাঁ দা ল গালেৎ, মা জলি (মাই প্রিটি গার্ল) দ্য ব্লু রুম, সালত্যাঁবাঁক, সেলফ-পোর্ট্রটে, টু নুডস, লা ভাই (লাইফ), স্কাল্পটর, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌল, থ্রি ড্যান্সার্স, গার্ল বিফোর এ মিরর, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোম, গ্যারসন আ ল্যা পাইপ ইত্যাদি।
জনমানসে 'আর্ট'-এর বোধগম্যতার ব্যপারে তিনি লেখেন, "সবাই দেখি, শিল্প বুঝতে চায়। আরে বাবা, পাখির গান বোঝার চেষ্টা করো না কেন? বোঝার চেষ্টা না-করে লোকে রাত্রিবেলাকে ভালোবাসে কেন, কেন ভালোবাসে ফুল? তার চারপাশে যা আছে, সে সব আগে বোঝার চেষ্টা না-করে আগেই ভালোবাসে কেন? ছবির ক্ষেত্রে লোককে 'বুঝতেই হবে!"
তাঁর সময়ের তরুণ শিল্পীদের কাজের ধরণ দেখে তিনি বলেছিলেন, "ছবিতে যাঁরা নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, সে রকম কয়েক জন ব্যাতিক্রমকে বাদ দিলে তরুণ শিল্পীরা আজ জানে না যে কোন দিকে যেতে হবে। আমাদের বিরোধিতা করার জন্যই আমাদের গবেষনার কাজ হাতে নেওয়ার বদলে তারা ফের অতীতকে ফিরিয়ে আনছে। অথচ গোটা বিশ্ব আমাদের সামনে সত্যিই খোলা পড়ে আছে- কেউ করবে বলে সব অপেক্ষা করছে। একই জিনিশ আবার করলে তো হবে না। যা-কিছু ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেছে, মরিয়ার মতো তা আঁকড়ে ধরে রাখার মানে কী? 'এর মতো', 'ওর মতো' ছবি তো গণ্ডায় গণ্ডায়, কিন্তু নিজের মতো কাজ করছে এমন তরুণের দেখা পাওয়া দুর্লভ।"
তিনি বিশ্বাস করতেন 'রিপিটেশন' অথবা 'পুনরাবৃত্তি' করা মানেই নিজের 'আত্ম'র বিরোধিতা করা, আর তার মানেই ফাঁকিবাজি, চালাকি, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তার বাবার নাম ডন জোসে রুইজি ব্লাস্কো এবং মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। পিকাসোর শিল্পী হওয়ার পেছনে তার বাবার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। কারণ পিকাসোর বাবাও একজন আঁকিয়ে ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই অঙ্কনের প্রতি পিকাসোর এক ধরনের ঝোঁক ছিল। ফিগার ড্রইং এবং তেলচিত্রের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই। শোনা যায়, তাঁর বাবা একবার একটি পায়রার ছবি আঁকছিলেন। একদিন দেখলেন, তাঁর অসমাপ্ত পায়রার ছবিটি পিকাসো এত নিখুঁতভাবে আঁকছে যে, তার বিশ্বাস হলো না একটি ১৩ বছরের ছেলে সেটা আঁকতে পারে। তাঁর বাবার মনে হলো পিকাসো তাঁকে ছাপিয়ে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন, আর ছবি আঁকবেন না তিনি। পিকাসোর অল্প বয়সে আঁকা ছবিগুলো দেখে সমালোচকরা তাঁকে রাফায়েলের সমকক্ষ বলতেন, আর পিকাসো বলতেন 'আমার ছবি আমার চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী। আমাকে দিয়ে সে তার চাহিদামাফিক কাজ করিয়ে নেয়।"
তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র শিল্পই যা কিনা প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় ধূলোবালি ঝেড়ে মুছে সাফ করে দিতে পারে, বিশুদ্ধ জীবন আসে বিশুদ্ধ শিল্পের হাত ধরেই।
দক্ষিণ ফ্রান্সের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা ছোট শহরের একটা জায়গা ভারি পছন্দের ছিল তাঁর, যে জায়গাটা প্রায় ৩০ বার এঁকেছিলেন 'ইম্প্রেশনিস্ট' শিল্পী পল সেজান। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপচে পড়ছে সেখানে, পিকাসো মজা করে বলেছিলেন "আমি সেজানের পাহাড় কিনে নিয়েছি।" সত্যিই সেখানকার একটা সম্পত্তি কিনে নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে মারা যান পাবলো পিকাসো, সেই মহান শিল্পী, যিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে বিশ্বাস করিয়েছেন এবং নিজেই বলে গিয়েছেন ‘তুমি যা কিছু কল্পনা করতে পারো তার সবই বাস্তব।’ (Everything you can imagine is real.)