একটা ছাদ। অনেকটা সুরক্ষা। আমাদের কাছে বাড়ি সব সময় কাছের হয়। আপনজনের উপস্থিতি বাড়িকে শক্তপোক্ত ছাদের মতই সুরক্ষা দেয়। প্রকৃতিও ঠিক তেমনই একটা বাড়ি। আমরা প্রত্যেকেই সেই বাড়ির সদস্য। গাছ-গাছালি, পশু-পাখিরা আমাদের অজান্তেই এই বাড়ির ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। আর প্রকৃতি নিজে আমাদের সুরক্ষিত রাখার সমস্ত আয়োজন করে রেখেছে। তেমনই এক ব্যবস্থার নাম ওজোন স্তর। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে আমাদের সুরক্ষা দিয়ে চলেছে অনন্ত কাল থেকে। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হওয়ার মূহূর্ত থেকেই পরিবেশ তার সবটুকু দিয়ে তাকে সকল সৃষ্টিকে এভাবেই আগলে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিবর্তে আমরা কি দিতে পেরেছি পরিবেশকে? পরিবেশ সংরক্ষণ করা তো দূরের কথা, আমাদের নিজেদের সুরক্ষিত রাখার প্রচেষ্টাতেও জল ঢেলে চলেছি প্রতিনিয়ত।
সূর্যের ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছানোর আগেই বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর তা শোষণ করে নেয়। ফলে সমস্ত জীবকূলই এর থেকে রক্ষা পায়। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি সরাসরি আমাদের চামড়ায় পৌঁছলে, সৃষ্টি হতে পারে গভীর ক্ষত। ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ , পশু-পাখি সকলেই। ওজোন স্তরের যে কোন ক্ষতি সমগ্র জীবকুলের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। ১৯৮০ সালে প্রথমবার ওজোন স্তরের ক্ষতির কথা জানান বিজ্ঞানীরা। তাঁরা গবেষণা করে জানান, পৃথিবী যত প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের পথে এগিয়ে যাবে, বৃদ্ধি পাবে দূষণের মাত্রা। ফলে বাড়বে ওজোন স্তরের ক্ষতি। ওজোন স্তরে বেশ কয়েকটি গর্ত দেখা গিয়েছে। যার ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সরাসরি পৃথিবীতে আসার প্রভূত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্তর্গত ১৯৬ টি দেশ এই বিষয়ে বিশেষ আলোচনা করে এবং বেশ কিছু নীতি নির্ধারণ করে। তৈরি হয় নির্দেশিকা- মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল। উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশ মিলিয়ে মোট ৪৭ টি দেশ ১৯৮৭ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সই করে এই মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলএ । এই নির্দেশিকার লক্ষ্যই ছিল দূষণের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশের ওজোন স্তরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। অর্থাৎ যে প্রকৃতি এতদিন দুহাত বাড়িয়ে আমাদের আগলে রেখেছিল বিনিময়ে তাকে সুরক্ষা ফিরিয়ে দেওয়া। যে দেশগুলিতে ক্লোরো ফ্লুরো কার্বনএর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা দূষণের মাত্রা কমানোর বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। গ্রীন হাউজ গ্যাস দৈত্যের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল পৃথিবীকে। তাকে সুরক্ষিত রাখা নিতান্তই জরুরি হয়ে পড়েছিল। ওজোন স্তরের ক্ষয়ের ফলে নানা চর্মরোগ বাসা বাঁধছিল বিভিন্ন দেশের মানুষের শরীরে। ১৯৯৪ সালের ১৯শে ডিসেম্বের প্রথমবার ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেম্বলি বিশ্ব ওজোন-স্তর সুরক্ষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিবছর ১৬ ই সেপ্টেম্বর দিনটিতে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,কারণ ওই দিনই সই করা হয়েছিল মন্ট্রিয়াল প্রোটোকল। এই দিনে সমস্ত দেশে পরিবেশের ওজোন স্তরের সুরক্ষা বৃদ্ধির জন্য নানা সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। প্রত্যেক বছর একটি বিশেষ থিম থাকে এই দিনের জন্য। ২০২০র থিম " জীবনের জন্য ওজোন-ওজোন স্তরের সুরক্ষা দানের ৩৫বছর"।
ওজোন স্তর আমাদের পরিবেশের নীলকন্ঠ। সমস্ত গরল পান করে আমাদের জন্য সুস্থ জীবনধারার আয়োজন করে চলেছে। ভারতে দূষণের মাত্রা ওজোন স্তরকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। তবে এই অতিমারি প্রকৃতির কাছে সঞ্জীবনী। লকডাউনে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেকটা কমেছে সমস্ত দেশেই। এমনকি ওজোন স্তরের ক্ষত সেরেছে। তবে যা ক্ষতি হয়েছে তার তুলনায় এই সেরে ওঠা নিতান্তই সামান্য। এমন ভাবে চললেও আজ থেকে ৪০বছর পূর্বের ওজোন স্তরে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছর। এখন আমাদের সচেতনতার বলয়ই একমাত্র বাঁচাতে পারে প্রকৃতির এই নীলকন্ঠকে।